রাহমান মনি / টোকিও
এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। সারা বিশ্বে চলছে করোনা ভাইরাসের মহামারী। জাপানে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, অনেক অফিস আগাম ছুটি দিয়েছে। জাপানে সংক্রমণের পিক চলছে, প্রচুর মানুষ আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞরা সংক্রমণের পিক, আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন প্রক্ষেপণ দিচ্ছেন। বিভিন্ন দেশে বসবাসরত প্রবাসীদের একের পর এক মৃত্যুর খবর আসছে।
দেশে সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে; ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১০৩ জন মারা গিয়েছে । মৃত্যু ভয়ে দেশের মানুষ শঙ্কিত। কেউ জানে না বাংলাদেশে কী ঘটতে যাচ্ছে কত মানুষ আক্রান্ত হবে, কত মানুষ মারা যাবে, কখন পিক হবে তার কোন ধারণা নেই। মানুষ হতাশ হয়ে তথ্য খুঁজছে। একটু ইতিবাচক তথ্য পেলেই সেটাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে,শেয়ার করছে।
এরই মাঝে এপ্রিল ২১, ২০২০ তারিখ রাতে জাপান প্রবাসী গবেষক বিজ্ঞানী ড.তপন পাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও গাণিতিক মডেল প্রয়োগ করে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে একটা প্রক্ষেপণ দেন। তিনি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে এই প্রক্ষেপণ শেয়ার করেন যা অনেক গণমাধ্যম কর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বিভিন্নজন এই পোস্টটা শেয়ার করেন।
তিনি তার প্রক্ষেপণে বলেছিলেন যে মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ১৬লক্ষ মানুষ করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হবে, প্রায় ৩.২ লক্ষ রোগীর উপসর্গ দেখা দিতে পারে, জুন ২১ তারিখে সংক্রমণের পিক হবে, প্রায় ৪,৭০০-২৪,০০০ মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। সংক্রমিত রোগীদের একটা বড় অংশের কোন উপসর্গ দেখা দিবে না। আর এর একটা অংশ মাত্র টেস্টে শনাক্ত হবে।
বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারক ও সাধারণ মানুষের জন্য ছিল এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রক্ষেপণ কিন্তু অনেকেরই তখন এই প্রক্ষেপণ বিশ্বাস হয়নি। তার প্রক্ষেপণ প্রকাশিত হবার পরের দিন সিংগাপুরের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্ষেপণ মে মাসের মধ্যে বাংলাদেশের করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ৯৭% শেষ হয়ে যাবে পত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। আর সাথে সাথে তার প্রাথমিক প্রক্ষেপণ নিয়ে শুরু হয় প্রচন্ড সমালোচনা। কেউ কেউ তার ফেসবুক পোস্টের মন্তব্যে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের লিংক শেয়ার করে দিতে লাগবেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বিভিন্ন পরিস্থিতি বিবেচনা করে আরো এগারোটি গাণিতিক মডেল তৈরি করেছিলেন এবং একটা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে শেয়ার করে দেখিয়েছিলেন যে মে মাসের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শেষ হবে এমন মডেল অবাস্তব।
আর তার এই প্রক্ষেপণ বাংলাদেশের কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর বাংলাদেশের সংক্রমণ নিয়ে আমেরিকা ও চীনের গবেষকদের মতামত বাংলাদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ড.তপন পাল সব সময় তার প্রক্ষেপণ নিয়ে ছিলেন আশাবাদী। তার প্রক্ষেপণ দেবার পর প্রায় পাঁচ মাস হতে চলেছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই সেপ্টেম্বর মাস শেষ হবে। এ মুহুর্তে মনে হচ্ছে ড.তপন পালের পাঁচ মাস আগে দেওয়া সেই প্রক্ষেপণ প্রায় সঠিক ছিল। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া স্বাস্থ্য বুলেটিন অনুযায়ী সেপ্টেম্বর ১২ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩,৩৬,০৪৪ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে যা তপন পালের প্রক্ষেপণের উপসর্গ দেখা দেওয়া রোগীর সংখ্যার কাছাকাছি আর মৃতের সংখ্যা ৪,৭০২ জন যা আগামী দুই-একদিনের মধ্যে প্রক্ষেপণের রেঞ্জের মধ্যে চলে যাবে।
এই মহামারীর সময়ে সম্ভাব্য কতজন মানুষ মারা যেতে পারে তা ছিল নীতি-নির্ধারকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ড.তপন পালের সেই প্রক্ষেপণ আজ নির্মম সত্য বলে প্রমাণিত। আর সংক্রমণের পিক নিয়েও তার প্রক্ষেপণটা সত্য বলে মনে হচ্ছে।
শুধু বাংলাদেশের করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে প্রক্ষেপণই নয়, তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও গাণিতিক মডেল প্রয়োগ করে প্রায় দুই মাস ধরে প্রতিদিন রাতে বাংলাদেশ ও জাপানের করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যার পূর্বাভাস দিতেন। পূর্বাভাসের পোস্টগুলো পাবলিক করে দেওয়ায় জাপান ও দেশের কিছু মিডিয়া কর্মীদেরও চোখ ছিল তার ফেসবুকের ব্যক্তিগত পেজে। অনেকে রাতে অপেক্ষা করতেন তার পূর্বাভাসের জন্য। তিনি বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যা নিয়ে এপ্রিল ২৪ থেকে মে ৩১ পর্যন্ত যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তা মে ৩১ তারিখ রাতে সামগ্রিক মুল্যায়ন করেছিলেন।
তাতে দেখা গেছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পাঁচটি মডেলই মোট শনাক্তের সংখ্যার কাছাকাছি পূর্বাভাস দিয়েছিল। তিনি জাপানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে সঠিক পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। আর জাপানের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যার পূর্বাভাসও অধিকাংশ দিন সঠিক ছিল।
কিন্তু কে এই তপন পাল? তিনি জাপান প্রবাসীদের মাঝে এক পরিচিত নাম। একজন গবেষক বিজ্ঞানী। ড. তপন পাল ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০০১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০১ সালে জাপান সরকারের মোনবুকাগাকুশো স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে জাপানে আসেন। জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী ও ২০০৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।
২০০৭ সালে জাপানের একটি বড় কোম্পানীতে গবেষক হিসেবে যোগদান করেন এবং বর্তমানে একই কোম্পানীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং বিষয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষক বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ড. তপন পাল Lulu.com কর্তৃক প্রকাশিত Handbook of Healthcare and Medical Condition-related Terms in Bangla, English and Japanese (ISBN-13: 978-0359459476) বইয়ের রচয়িতা ও CRC Press কর্তৃক প্রকাশিত Applied Genetic Programming and Machine Learning (ISBN-13: 978-1439803691) বইয়ের সহ-রচয়িতা।
rahmanmoni@gmail.com
মানবজমিন এর সৌজন্যে