Breaking News

“ঢাকা মানেই আমাদের কাছে প্রথমেই বেলাল চৌধুরী” রিটন খান

২০১৭ সালে বেলাল চৌধুরীর বই নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়-এর ডিজিটাল সংস্করণের জন্য তাঁর অনুমতি নিতেই ঢাকায় গিয়েছিলাম। জানতাম উনি প্রায় অসুস্থ থাকেন, তাই বিমানবন্দরে নেমেই তাঁর ছেলে প্রতীকের সাথে যোগাযোগ করে খোঁজ নিলাম কবি কেমন আছেন। ভাগ্যিস কবি সেদিন একটু সুস্থ ছিলেন।

দেরি না করে সেদিনই সন্ধ্যার পর কবির বাসায় যাই। অনেকক্ষণ কবির সাথে নানান বিষয় কথা হয়, যদিও উনি বলছিলেন অনেক কম, শুধু মুখ এক ধরনের দুষ্টুমিপূর্ণ হাসিতে উদ্ভাসিত রেখে শুনছিলেন আমার সব কথা। আমি একে একে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম কেন বাংলা সাহিত্যের আর্কাইভিং জরুরী, ই-বুকের প্রয়োজনীয়তা, ইত্যাদি। নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায় বইটির ই-বুক সংস্করণের জন্য উনি সানন্দে অনুমতি দিয়েছিলেন। আমি কবির হাত ধরে বসেছিলাম অনেক ক্ষণ।

Enlight142

প্রথাবিরোধী জীবনযাপন, কৃত্তিবাস-এর মত একটি পত্রিকার সম্পাদনা ছাড়াও প্রচুর ভালো কবিতা লিখে গেছেন কবি বেলাল চৌধুরী। ছন্নছাড়া জীবনযাপনের জন্য বন্ধুমহলে বেশ নাম ছিল তাঁর।

কবিতা সিংহ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, “…ঢাকা মানেই আমাদের কাছে প্রথমেই বেলাল চৌধুরী। তার অনেক পরে শেখ মুজিবুর রহমান। … বেলাল নাকি গাঁজা চণ্ডু চরস খায়। শ্মশানে বসে থাকে। খুব বড় বড় ব্যবসাদার মিনিস্টার সিউডো ইন্টালেকচুয়াল তার তাঁবে। বেলাল এসবেরও প্রতিবাদ করত না, মিটমিটি হাসত। বহু মহিলা বেলালের জন্য পাগল। তাই বেলালকে ঘিরে রহস্য। বেলালকে ঘিরে জল্পনা কল্পনা। কিন্তু সামনে এলেই, রবীন্দ্রনাথের অতিথি গল্পের সেই তারাপদকে মনে পড়ত। সেই পবিত্র অনাসক্ত অনঘ বালকটি।”

কবি শামসুর রাহমান কবি বেলাল চৌধুরী সম্পর্কে বলেছিলেন, “তরুণ কবিকর্মী ও সংস্কৃতিসেবীদের মুখে মুখে ফেরে যে কবির নাম তিনি বেলাল চৌধুরী। আজ গার্হস্থ্যের তাবুতে আশ্রয় নিলেও এক সময় প্রথাবিরোধী জীবনযাপনের মাধ্যমে তিনি এক কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন।”

পঞ্চাশ দশকের অনেকের স্মৃতিচারণেই জানা যায় যে বেলাল চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তানের এক জাহাজে করে পালিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। কোন জাদুর সম্পর্শে তিনি সম্পূর্ণ অচেনা এক বিশাল শহরের হৃদয় জয় করে ফেলেছিলেন সেটি তাদের বোঝানো যাবে না, যারা তখনকার বেলাল চৌধুরীকে দেখেনি। তাঁকে নিয়ে অনেক গল্প চালু ছিল,

একটা গল্প এরকম: সন্দীপনের (সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়) মিনিবুকে একটি বিজ্ঞাপন বেরোয়: ‘শীতার্তকে রাতের আশ্রয় দিই – বেলাল চৌধুরী’। এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। বেলাল তখন থাকত ক্যামাক স্ট্রিটের একটি ছিমছাম ঘরে শ্যামদেশীয় এক তরুণের দৌলতে। সেখানেই এক শীতের রাতে দরজায় করাঘাত। দরজা খুলে দিয়ে বেলাল দেখে মাথায় টাক, গায়ে কোট, পরনে লুঙ্গি, এক হাতে একটি বিশাল পোঁটলা, অন্য হাতে বগলের নীচে মাদুরে ঢাকা বিছানা, এক পঞ্চাশোর্ধ মহিলা। তিনি রাতের আশ্রয় চান। বলা বাহুল্য, এক অতিথিপরায়ণ বেলাল তাঁকে বিজ্ঞাপনের কথামত রাতের আশ্রয় দিয়ে নিজে বাইরে রইলেন।

সুজিত সরকার বেলাল চৌধুরীর এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কৃত্তিবাস পত্রিকায়। এক প্রশ্নের জবাবে কবির কলকাতা যাওয়ার কথা তাঁর নিজের মুখেই শোনা যাক।

“…আমি একসময় মাছধরার জাহাজে কাজ করতাম। যাকে বলে ট্রলার। ট্রলারে কাজ করতে করতে আমি কলকাতায় এসে পৌঁছাই। আমার হাতে তখন বেশ কিছু কাঁচা টাকা ছিল। আমার সঙ্গে পুরনো এক বন্ধুর দেখা হয়ে গেল। সে আমাকে কফি হাউসে নিয়ে গেল। বইপত্তর, পত্রপত্রিকা ঘাটাঘাটি করার ব্যাপারে আমার একটু শখ রয়েছে। আসলে আমি ছোটবেলা থেকেই পড়ে আসছি। কবিতা পত্রিকা থেকে শুরু করে বহু পত্রিকাই আমার সংগ্রহে ছিল। দেশ পত্রিকা প্রথম সংখ্যা থেকেই আমার বাড়িতে ছিল। মা-বাবা দুজনেই বইটই পড়তেন। বাবা বাড়িতে বই আনতেন। তিনি রেল কোম্পানিতে চাকরি করতেন। যখনই বাইরে থেকে আসতেন কিছু বই-পত্রপত্রিকা সঙ্গে থাকত। সেই সূত্রে পড়ার চলটা আমাদের বাড়িতে ছিল। তবে লেখালেখি করার কোনো চিন্তা আমার মধ্যে ছিল না। মার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। মাতৃহারা হয়েছিলেন ছোটবেলাতেই। মামার বাড়িতেই মানুষ হয়েছিলেন দিদিমার কাছে। উনি নবীনচন্দ্র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনর্গল মুখস্থ বলতে পারতেন। আত্মীয়স্বজনদের বিয়ে বা জন্মদিন উপলক্ষ্যে কবিতা রচনা করতেন। শুনে বেশ মজা পেতাম। আমার বাবার যে বিপুল বইয়ের সংগ্রহ ছিল, সেখান থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথমা পড়ি, বুদ্ধদেব বসুর হঠাৎ আলোর ঝলকানি। কুমিল্লার সঙ্গে আমাদের একটা যোগ ছিল। আমার জন্ম নোয়াখালির প্রত্যন্ত এক গ্রামে, কিন্তু আমি মানুষ হয়েছি কুমিল্লাতে। সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে কুমিল্লার খুব নাম ছিল। গান-বাজনায় কুমিল্লা ছিল অসাধারণ। শচীন কর্তা ছিলেন, আমার এক কাকা ছিলেন নজরুলের বন্ধু, আর এক কাকার নাম মোতাহের হোসেন চৌধুরী, তিনি লেখক ছিলেন। তা আমি যখন গ্রামের বাড়িতে থাকতাম, আমার মা একদিন আমার পকেটে একটা বিড়ির টুকরো আবিষ্কার করেছিলেন। উনি হয়ত আমার ভালোর জন্যই আমাকে পিসিমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, একপ্রকার বনবাসেই। বনবাস বলতে সন্দ্বীপ। আমার পিসেমশায় সন্দ্বীপের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি অসাধারণ পড়ুয়া ছিলেন। এন্ট্রান্স পাশ করা কোনো মানুষের পড়াশোনা এত গভীর হতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বহু মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে ওঁর কথা শুনতো। সবচেয়ে বড় কথা, উনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। সন্দ্বীপে দুটি স্কুল ছিল, একটি কার্গিল হাইস্কুল, আরেকটি সন্দ্বীপ হাই স্কুল। আমি কার্গিল হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ওখানে আঞ্চলিক লোকেরা তো ছিলই, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রচুর লোক ওখানে থাকতেন। যে মাস্টারমশাই আমাকে পড়াতেন তিনি ছিলেন যোগেশচন্দ্র পাঠক। উনার সঙ্গে প্রায় একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। উনি আমাকে দিয়ে স্কুলের নাটক করাতেন, এটা করাতেন, সেটা করাতেন। বেশ ভালো লাগতো। মা-ভাইবোনদের ছেড়ে আমার যে দুঃখ ভেতরে ভেতরে অনুভব করতাম, উনার সাহচর্যে এসে সেসব ভুলে যেতাম। সন্দ্বীপ শহরটা অতটুকু হলে কী হবে, সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল সাংঘাতিক। সেখানে একজনকে পরবর্তীকালে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। তিনি হলেন পার্থসারথি চৌধুরী। ওঁর বাবা ছিলেন আমাদের মাস্টারমশাই। পার্থকে আমি আবিষ্কার করি কলকাতায় এসে। সন্দ্বীপে হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক বিভেদ নিয়ে উত্তেজনা ছিল। মসজিদে হয়ত নামাজ পড়া চলছে, তখন এদিক থেকে জোরে জোরে ঢাকবাদ্যিও বাজছে। এটা ঘিরে একটা উত্তেজনা ছিল। কিন্তু আমার পিসেমশায় এই সাম্প্রদায়িক বিভেদকে দৃঢ় হস্তে থামিয়েছিলেন। ওঁর মানসিকতায় আমি গড়ে উঠেছি। যার ফলে ইসলামিক শিক্ষাদীক্ষা আমার কখনো হয়নি। আমার বাবা-মা ধর্মপরায়ণ ছিলেন। কিন্তু উনারা রবীন্দ্রনাথের এত ভক্ত ছিলেন যে ওঁরা মোনাজাত যেটা করতেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। এই পরিবেশের মধ্যে মানুষ হয়েছি। লিখবো যে কোনোকালে ভাবিনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমি কুমিল্লাতে ছিলাম। আস্তে আস্তে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে উঠলাম। তবে কুমিল্লায় লাইব্রেরি প্রচুর ছিল। বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, অমূল্য স্মৃতি পাঠাগার, আরো অনেক লাইব্রেরি। সব লাইব্রেরি থেকেই আমি বই নিয়ে আসতাম। মনে পড়ে এক বৃষ্টির রাতের কথা। সকাল থেকেই আকাশে ঘন মেঘ, গুড়গুড় করছে। আমি তিন মাইল দৌড়ে তিনটে লাইব্রেরি থেকে তিনটে কিরীটির বই আনলাম। তখন কিরীটির বই পড়ার নেশা ছিল। তো, সেই রাতে, হ্যারিকেনের আলোয়, তখন তো ইলেকট্রিসিটি ছিল না, তিনটে বই শেষ করেছিলাম। তখন কলকাতা থেকে অনেক পত্রপত্রিকা ওখানে যেত। তারপর শুরু হলো আমার ভাসমান জীবন। উল্টোরথ, প্রসাদ, ইদানীং, চতুরঙ্গ  সব রকমের পত্রপত্রিকাই যেত। সেই প্রথম সুনীলদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাঘ নামে একটা গল্প পড়ি। পরে শুনেছিলাম, ওটাই সুনীলদার প্রথম গল্প। এইভাবে সাহিত্য রুচি গড়ে ওঠে। বাড়ি পালিয়ে ঢাকা যেতাম। ঢাকায় তখন ভাষা-আন্দোলন চলছে। তাতেও জড়িয়ে গিয়েছিলাম। (ফজলে) লোহানী ভাই তখন অগত্যা বের করছেন। এই লোহানী ভাইয়ের কাছেই প্রথম শুনি বিষ্ণু দে-র কথা, কলকাতার কথা। লোহানী ভাই যে কলেজে পড়তেন, বিষ্ণু দে ছিলেন সেই কলেজের মাস্টারমশাই। জীবনানন্দ দাশের কথা প্রথম শুনি। প্রচুর পড়তাম। উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে আশালতা সিংহ কিছুই বাদ দিইনি। তবে লেখার কথা একেবারেই ভাবিনি। এরপর কাজটাজ শিখে টাকা রোজগারের উদ্দেশ্য নিয়ে চট্টগ্রামে মামার কাছে পৌঁছলাম। সেখানে ‘নিউজফ্রন্ট’ নামে একটা বইয়ের দোকান ছিল। সেখান থেকে প্রচুর বই কিনতাম। তখন সুবোধ ঘোষ আমার ফেভারিট লেখক। রাজশেখর বসুর সব বই পড়েছিলাম সেই বয়সে। আমার মতো সুবোধ ঘোষ পড়েছে কেউ আমার সময়ে, আমার ধারণা নেই। পড়তে পড়তে কমলকুমার মজুমদারকে একদিন আবিষ্কার করি ঢাকাতে, এক বইয়ের দোকানে, অন্তর্জলী যাত্রা। ওঁর ভাষারীতি আমাকে এতটাই মুগ্ধ করল যে আমি ওঁর ভক্ত হয়ে পড়লাম। পুরনো দেশ-এ ওঁর একটা-দুটো গল্প পেলাম। চতুরঙ্গ-এ পড়লাম ওঁর গল্প মল্লিকাবাহা। তারপর তো মাছ ধরার কাজ করতে করতে কলকাতায় আসা। আমার এক দাদু পার্কসার্কাসে থাকতেন। উনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের খুব স্নেহাস্পদ ছিলেন। উনার নাম ছিল খান বাহাদুর আবদুর রশীদ খান। উনি ক্যালকাটা কর্পোরেশনের প্রথম মুসলিম একজিকিউটিভ। সুহরাওয়ার্দিদের বাড়ির পাশেই উনি বাড়ি করেছিলেন। ওই বাড়িতেই আশ্রয় নিলাম। সে সময়েই আমার এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়। ওই আমাকে কফি হাউসে নিয়ে গেল। কফি হাউসেই টুকটুক করে কয়েকজন তরুণ লেখকের সঙ্গে আলাপ হলো। ওদের সঙ্গে বেশ জমে গেলাম। ওই করতে করতে শক্তিদার (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে আলাপ। শক্তিদা আর আমি যেভাবে কাটিয়েছি, স্বামী-স্ত্রীও বোধহয় ওভাবে জীবন কাটায় না। শক্তিদার বাড়ি যাওয়া, শক্তিদার মা আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। শক্তিদা তখন উল্টোডাঙ্গায় অধর দাস লেনে থাকতেন। তিন কামরার একটা বাড়ি। মাঝের কামরায় ওঁরা থাকতেন। শক্তিদার মা, শক্তিদা, শক্তিদার ভাই ভক্তি। শক্তিদাকে একদিন বদ্ধ মাতাল অবস্থায় কফি হাউস থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। শক্তিদাকে ট্যাক্সি করে নিয়ে গিয়েছি। গিয়েই শক্তিদা সব জামাকাপড় খুলে ফেললো। শুধু আন্ডারওয়ার পরা। শক্তিদা সেই অবস্থায় নাচতে শুরু করেছে। ওর একটা টিপিক্যাল নাচ ছিল। মাসিমা বলছে : ‘হাবলা, চুপ করলি, চুপ করলি।’ কে চুপ করে! শক্তিদার আবার সাহেবি চাল ছিল। গরম জল ছাড়া চান করতে পারতো না। বাড়িওয়ালার দুটি সোমত্ত মেয়ে ছিল। তারা চট করে খাটের নীচে লুকিয়ে পড়লো। আর শক্তির ভাই বলছে : ‘আজ মেরে ফেলব, কেটে ফেলব, এ আর সহ্য হয় না।‘”

যেখানেই কবিতা সেখানেই বেলাল চৌধুরী। দুই বাঙলার কবিতা বিষয়ক যত আন্দোলন সব কিছুর সাথে বেলাল চৌধুরী মিশে ছিলেন হৃদয়ের স্পন্দনের মতো। তাই তো কি কলকাতা, কি বাংলাদেশ, সকলেই বেলাল চৌধুরীকে নিজেদের কবি বলে দাবি করেন।

সুনীল ও বেলাল ছিলেন হরিহরাত্মা। অনেক বছর পরে সুনীল দুঃখ করে লিখেছিলেন, “বেলাল, তুই কেমন আছিস? বুকটা মুচড়ে ওঠে, কেন বল তো? ”

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক অর্ধেক জীবন বইয়ে বেলাল চৌধুরীর সাথে তাঁর সাক্ষাতের এক চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়েছেন। পাঠকদের জন্য অর্ধেক জীবন বইটি থেকে তা তুলে ধরা হলো।

“কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের সিড়ির মুখে প্রতিদিন সিগারেট বিক্রি করে ইসমাইল, সে আমাকে দেখে একটা ছোট্ট স্মাইল দিয়ে জিজ্ঞেস করল, অনেকদিন আসোনি, কোথায় ছিলে? আমি তার একজন বিশিষ্ট ক্রেতা, কারণ ধারে কিনতে পারি, সুতরাং সে তো আমাকে মনে রাখবেই। মার্কিন দেশে আমার ব্র্যান্ড ছিল লাকি স্ট্রাইক, ফরাসি দেশে গোলোয়াজ, কলকাতায় আবার ফিরে এলাম চারমিনারে। একটা সিগারেট ধরিয়ে যেন গতকালই আমি এখানে আড্ডা দিয়ে গেছি, সেই ভঙ্গিতে ঢুকলাম দোতলার হলে। আমার ফেরার খবর প্রায় কারোরই জানা ছিল না। দু’ তিনটি টেবিল থেকে বিস্ময়ে স্বাগত জানাল বন্ধুরা। শংকর চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বরই সবচেয়ে জোরালো, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর গালের রং দেখছি কমলালেবুর মতন হয়ে গেছে। সত্যি নয়, বড় জোর বেগুনি হতে পারে, চুলের ছাঁট ক্রু কাট করেছিস কেন, এই লাল জামাটা আমাকে একদিন দিস পরে দেখব। তখন শ্যামল আর আমার শরীরের গড়ন প্রায় এক রকম, যদিও শ্যামল অনেক বেশি সুপুরুষ। দু’জনের পদবী এক হওয়ায় শ্যামল অনেক জায়গায় বলত, আমরা দুই ভাই, আমাদের ঠাকুরদার নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (স্বর্ণলতা-এর লেখক), আমাদের বাবা উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (শরৎচন্দ্রের মামা ও বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক), আর নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আমাদের কাকা। জমজমাট কফি হাউসে চেয়ারের খুব অভাব, অনেক দূরের টেবিল থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে বসলাম এবং বলা যেতে পারে, ঝাঁকে মিশে গেলাম।

“খানিক বাদেই প্রস্তাব উঠল, খালাসিটোলায় যাওয়া হোক, সেখানে পাওয়া যাবে কমলকুমার মজুমদারকে।

বন্ধুদের দলে সাবলীলভাবে মিশে থাকা সম্পূর্ণ অচেনা একজনকে দেখলাম, তার নাম বেলাল চৌধুরী। সম্পূর্ণ মেদহীন সুগঠিত শরীর, ফর্সা রং, নিস্পাপ, সুকুমার মুখখানিতে ঈষৎ মঙ্গোলীয় ছাপ। এই নিরীহ যুবকটি সম্পর্কে অনেক রোমহর্ষক কাহিনী (হয়তো পুরোটা সত্যি নয়, সব রোমহর্ষক কাহিনীই তো সত্যি-মিথ্যে-গুজব মিশ্রিত হয়ে থাকে) শোনা গেল। তার বাড়ি পূর্ববঙ্গ তথা, পূর্ব পাকিস্তানে, পেশা কুমির ধরা। একটা কুমির-শিকারী জাহাজে অনেক সাগর-উপসাগর পাড়ি দিতে দিতে সে হঠাৎ খিদিরপুরে এসে জাহাজ থেকে নেমে পড়েছে এবং পাসপোর্টটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে মিশে গেছে কলকাতার জনারণ্যে। এবং সে একজন কবি, তাই জল যেমন জলকে টানে, সেইভাবে সে যুক্ত হয়ে গেছে কফি হাউসের কবির দঙ্গলে। পাকিস্তানের সঙ্গে তখন ভারতের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে দিনকে দিন, কয়েক মাস পরেই শুরু হবে একটি বালখিল্যসুলভ যুদ্ধ, সেরকম আবহাওয়ায় পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও সহায়সম্বলহীন অবস্থায় কলকাতায় বিচরণ করার জন্য প্রচণ্ড মনের জোর ও সাহসের দরকার। অবশ্য বেলালের একটা দারুণ সম্পদ ছিল, সেটা তার মুখের হাসি এবং সহজ আন্তরিকতায় মানুষকে আপন করে নেবার ক্ষমতা। পরে অনেকধার দেখেছি, যে কোনও বাড়িতে গেলে সে পরিবারের বাচ্চা ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বুড়ো বুড়িরা পর্যন্ত কিছুক্ষণের মধ্যেই বেলালকে ভালোবেসে ফেলে। এর মধ্যে সে কমলদারও খুব চেলা হয়ে গেছে, দুজন অসমবয়সী মানুষের এমন গাঢ় বন্ধুত্বও দুর্লভ।

“বেলালের মতন মানুষদের কোনও একটা বিশেষ দেশের সীমানায় গণ্ডিবদ্ধ করা যায় না, এরা সারা পৃথিবীর নাগরিক। বাউণ্ডুলেপনায় বেলাল শক্তিকেও অনেকখানি হার মানিয়ে দিয়েছিল।

“বেলালের সঙ্গে পরে অনেকবার অনেক রকম রোমহর্ষক অভিযান করা গেছে, কিন্তু আলাপের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতাটি চিরস্মরণীয়। হলো কী, খালাসিটোলায় অত্যুৎসাহে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। বছর খানেক ধরে উত্তম স্কচ, বার্বন ও ফরাসি ওয়াইন পান করে আমার অভ্যেস খারাপ হয়ে গিয়েছিল, বাংলা মদের মতন অতি উপাদেয় পানীয় আমার সহ্য হলো না, কোন মুহূর্তে যে চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পেল তা টেরও পাইনি। তখন আমার সেই জড় দেহ নিয়ে বন্ধুরা খুবই মুশকিলে পড়েছিল, তাদের তখনও ভালো করে নেশাই জমেনি, বেশি রাতও হয়নি।

“আমার জ্ঞান ফিরে এল ভোরবেলা। চোখ মেলে প্রথমে বুঝতেই পারলাম না, কোথায় শুয়ে আছি। রাস্তাঘাটে নয়, শ্মশানে-মশানে, হট্টমন্দিরে নয়, একটা ঘরেই, সেরকম ঘরও কখনও দেখিনি। চ্যাঁচার বেড়া, ওপরে টিনের চাল, ঘরখানা এমনই ছোট যে মাঝখানে একটা তক্তপোশ ছাড়া আর নড়াচড়ার জায়গাই নেই বলতে গেলে। আমার পরনে সোয়েটার-প্যান্ট-শার্ট-জুতো সবই আছে। এখানে এলাম কী করে, কার সঙ্গে, তা কিছুই মনে নেই। চিৎ হয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম একটুক্ষণ, পিঠে কীসের জন্য খোঁচা লাগছে, চাদরের তলায় হাত ঢুকিয়ে দেখি, একটা মোটা বই। সে বইটা টেনে সরাতেই সেদিকটা নিচু হয়ে গেল, তারপর ধরমড় করে উঠে দেখি; তোশক বলতে কিছুই নেই, একটা কাঠের চৌকির ওপর নানান আকারের সাজানো বইয়ের ওপর চাদর পাতা। আমি এতগুলি বইয়ের ওপর রাত কাটিয়েছি? এটা কার ঘর, জায়গাটাই বা কোথায়? বাইরে যেন কাদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, সবই নারীকণ্ঠ, কান পেতে শুনলাম, কী নিয়ে যেন ঝগড়া চলছে, তার মধ্যে অনেক অশ্লীল গালিগালাজ, যার অধিকাংশই পুরুষদের পক্ষে প্রযোজ্য, অর্থাৎ পুরুষরা প্রতিপক্ষের মা-বোন সম্পর্কে যেসব কুপ্রস্তাব করে, মেয়েরাই বলছে সেইসব। দরজাটাও চাটাই ও কঞ্চির, টেনে খুলতে গেলে একটুখানি ফাঁক হল মাত্র, বাইরে থেকে তালাবন্ধ। ফাঁক দিয়ে দেখে মনে হল, বাইরেটা একটা কবরখানা, মাঝে মাঝে বাটনাবাটা শিলের মতন পাথর বসানো।

“মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে ভাববার চেষ্টা করলাম, সবটাই কি দুঃস্বপ্ন ? এটা বাস্তব হতেই পারে না। মাত্র কদিন আগেই আমি ছিলাম আমেরিকায়, সে ঘরের তিনদিকেই জানলা। আমার বিছানার গদিটি ছিল পালক ভরা, আর কাল রাতে আমি শুয়েছি তোশকহীন তক্তপোশে, উঁচু-নিচু বইয়ের ওপর, চাঁচার বেড়ায় জানলাহীন ঘর, পরিবেশ কবরখানা, স্ত্রীলোকেরা গালাগালি বিনিময় করছে পুরুষদের ভাষায়, দরজায় তালা বন্ধ, এটা একটা সুররিয়াল দৃশ্য, এটা কারও অবচেতনের সৃষ্টি, আমি সেখানে একটা চরিত্র হয়ে গেছি। পাখি নয়, শুনছি শুধু চিলের ডাক, এরকম দৃশ্যে এমন আবহসঙ্গীতই মানায়। এখন আমার বসে বসে বইগুলি পড়া উচিত? আস্তে আস্তে মাথা পরিষ্কার হতেই পেটে খিদের কামড় টের পাই। নিশ্চিত কাল বিকেলের পর কিছু খাওয়া হয়নি, খালাসিটোলায় আদা আর ছোলা, কমলদার পরিহাসময় মুখ, এ ছাড়া আর কিছু মনে পড়ে না। এরকম চেতনা হারানো, এরকম অ্যামনেশিয়া আমার প্রথম হল। যে-ই আমাকে এখানে আনুক, দরজায় তালা লাগিয়ে রেখেছে কেন? দরজাটা ধরে ঝাঁকালাম কয়েকবার। কার নাম ধরে ডাকব জানি না। এখানে কে আছে, দরজা খুলে দাও, দরজা খুলে দাও! আমার চিৎকারে স্ত্রীলোকদের ঝগড়া স্তব্ধ হয়ে গেল, কয়েকজন উঁকিঝুঁকি মারল দরজার কাছে এসে। এই দৃশ্যটাও অলীক মনে হয়, একটা অচেনা স্থানে, অচেনা কারও ঘরে আমি বন্দী, বাইরে কয়েকজন রমণী কৌতুহলী চোখে দেখছে। তারা কেউ এই ‘বন্দীই আমার প্রাণেশ্বর’ বলল না, দৃশ্যটির মধ্যে রোমান্টিকতার ছিটেফোঁটাও নেই, রমণীরা কেউ সুন্দরী তো নয়ই, যুবতীও নয়, মধ্যবয়সী দজ্জাল ধরনের, রমণী শব্দটাই এখানে প্রযোজ্য নয়, একজনের মুখ বন-বিড়ালের মতন, একজনের স্পষ্ট গোফ, একজনের হাতে একতাল গোবর। তাদের চোখে বিস্ময় নেই, কোনও মন্তব্যও করল না, একটু পরেই আবার সরে গেল দূরে।

“অর্থাৎ আমাকে বন্দীই থাকতে হবে? কতক্ষণ? কী কী অপরাধ করেছি কাল রাতে? কিছু মনে করতে পারছি না বলে অপরাধবোধ আরও তীব্র হয়। অজ্ঞাত অন্যায়ের জন্য অনুশোচনায় সিরসির করে সর্বাঙ্গ। কাল রাতে বাড়ি ফিরিনি, বাড়িতে খবর দেবারও উপায় নেই, তখন টেলিফোনের এত চল ছিল না, মা দারুণ দুশ্চিন্তা করছেন, এটা ভেবেও লজ্জা-পরিতাপে অবশ লাগে। ঘরটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, বই ছাড়া আর প্রায় কিছুই নেই, এখন এরকম অবস্থায় কি বই পড়ে সময় কাটানো যায়? একটা বাঁশি থাকলেও না হয় সান্ত্বনা পাওয়া যেত, একজন বন্দী-মানুষ বাঁশির সুরে মগ্ন হয়ে আছে, এ দৃশ্যটাও এখানে মানিয়ে যায়।

“ইচ্ছে করলে লাথি মেরে মেরে ভেঙে ফেলা যায় চ্যাঁচার বেড়ার দেওয়াল। কিন্তু কার ঘর আমি ভাঙব? দরজাটাও তেমন মজবুত নয়, টানাটানি করে সেটা ওপরের দিকে খানিকটা তোলা যায়, তলায় খানিকটা ফাঁক হয়। আমি মাটিতে শুয়ে পড়ে, গড়িয়ে গড়িয়ে দরজার তলা দিয়ে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করলাম বেশ কিছুক্ষণ ধরে, পিঠ ও হাত-পা ছড়ে গেল, দরজাটা পটপট শব্দে হেলে পড়ল এক দিকে, তারই মধ্যে কোনওক্রমে নিষ্ক্রান্ত হওয়া গেল। মুক্তি, মুক্তি! একজন বেশ ভালো, বিলিতি জামা কাপড় পরা মানুষ যাকে এখানকার কেউ আগে দেখেনি, সে কেন সারা রাত এই একটা ঘরে তালাবন্ধ ছিল, কেনই বা সে দরজা প্রায় ভেঙে বেরিয়ে এল, তা নিয়ে পূর্বোক্ত “স্ত্রীলোকেরা কোনও প্রশ্ন করল না, ভ্রুক্ষেপও করল না। জায়গাটা একটা কবরখানাই বটে, এক দিকে বাঁশ ও দর্মার বেড়া দেওয়া এরকম আরও কয়েকখানা ঘর রয়েছে, মনে হয় জবরদখল। আরও খানিকটা জমি দখল করার বিবাদে সেই স্ত্রীলোকেরা প্রমত্ত বলেই মনে হল।…

“পরে জেনেছিলাম, আগের রাতে আমি অকস্মাৎ অচেতন এবং অসাড়-শরীর হয়ে যাবার ফলে বন্ধুরা খুব বিব্রত হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য তারা যাকে বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমার নাগেরবাজারের বাড়ি অনেকেই চেনে না, তা ছাড়া ওই অবস্থায় ট্যাক্সিতে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই, তাতে অনেক ভাড়া। এরকম পরিস্থিতিত্বে কেউ কেউ দায়িত্ব এড়িয়ে সরে পড়ে,কেউ কেউ বুক দিয়ে আগলে রাখে। সেই প্রথম পরিচয়ের দিনেই বেলাল আমার দায়িত্ব নিয়েছিল। তখন বন্ধুদের মধ্যে, একমাত্র উৎপলকুমার বসুই নিজের বাড়ি বিক্রি করে সাহেবি কায়দায় আধা সাহেরপাড়া রয়েড স্ট্রিটে একলা ফ্ল্যাটে থাকে, সেখানে অনেকেই হুল্লোড় শেষে রাত্রিযাপন করে। আমাকে সেখানেই শুইয়ে রাখা যেত; কিন্তু সিড়ি দিয়ে দোতলায় তোলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বেলাল আমাকে নিজের ঘরে রেখে আসে। বাইরে থেকে তালা দেবার কারণ, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার জ্ঞানও ‘আমার ছিল না, দরজা খোলা রাখলে পাশের বস্তির ছেলেরা ভেতরে ঢুকে অনেক কিছু চুরি করে নিতে পারত। চুরি করার মতন সম্পদ বেলালের ঘরে প্রায় ছিলইনা, বই ছাড়া তা কে আর নেবে! কিন্তু দেশের চোর-ডাকাতরা এমনই ছ্যাঁচড়া : যে বেলালের চৌকির নীচে রাখা দু’-একখানা জামাকাপড় বা থালা-গেলাসও নিতে পারে, তা ছাড়া আমার গায়ের সোয়েটারটা বেশ দামি। নেবার মত কিছু না পেলে রাগের চোটে চোর-ডাকাতরা খুনও করে যায়।

“জীবনে ওরকমভাৱে অচৈতন্য আমি একবারই হয়েছি। পরের বহু বছর ধরে দেখেছি, ওরকম তুরীয় অবস্থায় পৌঁছবার অধিকার আসলে বেলালেরই একচেটিয়া। স্থান-কাল-পাত্র কিছুই সে গ্রাহ্য করে না। এমন অনেকবার দেখেছি, কোনও বাড়িতে সান্ধ্য আড্ডায় আমরা বেলালকে নিয়ে গেছি, হয়তো কোনও সভ্রান্ত পরিবার, বেলালকে তারা আগে দেখেনি। কিছুক্ষণ পানাহারের পর কথা বলতে বলতে বেলাল হঠাৎ অজ্ঞান এবং পাথর। তাকে বাধ্য হয়েই সেখানে শুইয়ে রেখে আমরা চলে গেছি, কিন্তু কোনও বাড়িতেই বেলাল সম্পর্কে সামান্যতম অভিযোগও শোনা যায়নি, বরং সেসব পরিবারের সঙ্গে বেলালের দীর্ঘস্থায়ী সুসম্পর্ক হয়ে গেছে। এবং তরুণীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা আমাদের কাছেও ঈর্ষণীয় ছিল।

“অন্য দেশের নাগরিক হয়েও কলকাতার এক অজ্ঞাত কবরখানায়, জবরদখল জমির বাড়িতে, তাও কুড়ি-পঁচিশ টাকার ভাড়ায় বেলাল যে-ভাবে দিনযাপন করেছে তাতে মনে হয়েছে, এ ছেলে নিশ্চিত কোনও ছদ্মবেশী রাজকুমার। আমি, সে রকমভাবেই বেলালকে গ্রহণ করেছি প্রথম দিন থেকে। এরকম বেপরোয়া সাহস আমার কোনওদিনই ছিল না। আমি নিজে যা পারি না, তা অন্য কারও সহজসাধ্য দেখলে আমার শ্রদ্ধা হয়।

কিছুদিন পর বেলাল ক্যামাক স্ট্রিটের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়ায় একটা ঘুপচি ঘর নিয়েছিল, সেখানেও চলত আমাদের তুমুল আড্ডা ও নানা রকম গোপন পরীক্ষা। সেসব কথা লেখার ভার রইল বেলালের ওপর।“

সেসব কথা আমাদের আর শোনা হবে না। কারণ যেই ছদ্মবেশী রাজকুমারের গল্পের ঝুলি এমন নানান চমকপ্রদ গল্পে ঠাসা, তিনি অজস্র মানুষের ভালবাসার মায়াজাল ছিন্ন করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

কবিতা সিংহ তাঁকে রবীন্দ্রনাথের অতিথি গল্পের তারাপদের সাথে তুলনা করেছিলেন। আজ তার প্রস্থানে অতিথি গল্পের শেষ বাক্যটি মনে পড়ছে:

“স্নেহ-প্রেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্রবন্ধন তাহাকে চারি দিক হইতে সম্পূর্ণরূপে ঘিরিবার পূর্বেই সমস্ত গ্রামের হৃদয়খানি চুরি করিয়া একদা বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্রাক্ষ্মণবালক আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর নিকট চলিয়া গিয়াছে।“

About admin

Check Also

Gratis hardcoreporn filmer smoking – watch free porn online mature milf

Sex Asiatiske kjrlighet dating site asiatiske dating nettsteder toronto Her beskrives alt webcam sex live …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *