আধুনিককালে জাপান এবং অবিভক্ত বাংলার যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তার সূচনা হয়েছিল মেইজি সম্রাট মুৎসুহিতো (১৮৬৭-১৯১২) এবং বাংলার বিখ্যাত ঠাকুর বংশের বিশ্বখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ এবং সঙ্গীতশিক্ষার অগ্রদূত রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের (১৮৪০-১৯১৪) মধ্যে বাদ্যযন্ত্র বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। ১৮৭৭ সালে শৌরীন্দ্রমোহন মেইজি সম্রাটকে তিনটি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র পাঠান। বিনিময়ে সম্রাট শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গীতপ্রীতির কথা জানতে পেরে জাপানের বারোটি বাদ্যযন্ত্র উপহার হিসেবে প্রেরণ করেন।
এই ঘটনার প্রায় পঁচিশ বছর পর জাপানের নমস্য পণ্ডিত এবং শিল্পকলার ইতিহাসবিদ শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন (১৮৬৩-১৯১৩) ১৯০২ সালে কলকাতায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬৩-১৯০২) মাধ্যমে। আধুনিককালে প্রথম যে বাঙালি জাপানে পদার্পণ করেছিলেন তিনি স্বামী বিবেকানন্দ, ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগদানের পথে জাপানে কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন। যদিওবা জাপানে দুজনের পরিচয় হয়নি, হাওড়া জেলার বেলুর মঠে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতার মাধ্যমে।
এই সূচনা থেকে জাপান-পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ভাববিনিময়ের যে ইতিহাস সেটা অনেক দীর্ঘ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। তাই বলে পূর্ব বাংলার সঙ্গে জাপানের যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সেটাও আদৌ অনুজ্জ্বল নয় বরং ভিন্নমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ।
১৯০৮ সালে মনীষী প্যান-এশিয়ানিস্ট ওকাকুরার ভাবশিষ্য বৌদ্ধপণ্ডিত কিমুরা নিক্কি (কিমুরা রিউকান) (১৮৮২-১৯৬৫) বৌদ্ধদর্শন ও পালিভাষা শেখার জন্য চট্টগ্রামে যান। পণ্ডিত শ্রীমৎ ধর্মবংশ মহাস্থবিরের (জন্ম-মৃত্যু ?) কাছে উক্ত বিষয়াদি শিক্ষালাভ করেন। এছাড়াও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৌদ্ধপণ্ডিত ড.নলিনাক্ষ দত্তের (১৮৯৩-১৯৭৩) কাছে বাংলা ভাষা শিখেন। মেধাবী কিমুরা ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৬৪-১৯২৪) আহবানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে এই বিভাগেরই তিনি অধ্যাপক হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর গভীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। ১৯১৬ সালে কবিগুরু প্রথম জাপান সফরে এলে পরে তিনি তাঁর দোভাষী হিসেবে কাজ করেছিলেন।
কিমুরা নিক্কিরও আগে ১৯০৭ সালে জাপানি নাগরিক সাবান প্রযুক্তিবিদ উয়েমোন তাকেদা’র (?-১৯৪৮)সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ঢাকার খিলগাঁওস্থ এক ব্রাহ্ম দম্পতি শ্রী শশিভূষণ মল্লিক (?-১৯২৬) ও শ্রীমতী নগেন্দ্রবালা’র (?-১৯০৭) কন্যা হরিপ্রভা মল্লিক (১৮৯০-১৯৭২)। বিয়ের পর হরিপ্রভা তাকেদা ১৯১২ সালে স্বামীসহ জাপানের শ্বশুরালয় ভ্রমণ করেন। ১৯২৪ সালেও জাপান ভ্রমণ করেন। তৃতীয়বার ১৯৪১ সালে তাকেদা দম্পতি জাপান করেন এবং ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁরা জাপানপ্রবাসী মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু (১৮৮৬-১৯৪৫) ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’র (১৮৯৭-?) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নেতাজির অনুরোধে হরিপ্রভা ‘আজাদ হিন্দ্ ফৌজে’র পক্ষে রেডিও মারফৎ প্রচারকাজ করেছিলেন ১৯৪১ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে। হরিপ্রভা তাকেদা জাপান ভ্রমণ নিয়ে একটি গ্রন্থও লিখেছিলেন ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’ নামে যা জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটি অসামান্য দলিল। অবশ্য আরেকজন বঙ্গরমণী সরোজনলিনী দত্ত (১৮৮৭-১৯২৪) স্বামী এবং পুত্রসহ জাপান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন ‘জাপানে বঙ্গনারী’ নামে। উল্লেখ্য যে, তাঁর স্বামী ছিলেন লেখক, লোকসাহিত্য গবেষক, বিপ্লবী এবং ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সিলেটের গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১)।
উল্লেখিত হরিপ্রভার অনেক আগেই দুজন পূর্ব বাংলার অধিবাসীর জাপান-অভিজ্ঞতার কথা জানা যায় বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাসে’র (১৯৬৪-) অনুসন্ধান থেকে: তাঁরা হলেন সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধায় (১৮৮২-?) এবং মন্মথনাথ ঘোষ (১৮৮২-?)। তাঁরা দুজনেই ১৯০৬ সালে জাপানে আসেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের জন্য। মন্মথনাথ দুবার জাপানে আসেন। দুজনেই জাপানের অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রন্থাদি প্রকাশ করেন ১৯১০-১৯১৫ সালের মধ্যে। তাঁদের গ্রন্থ থেকে এশিয়ার একমাত্র স্বাধীন এবং শিল্পোন্নত রাষ্ট্র জাপান সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। এছাড়াও, সুব্রত কুমার দাস লিখিত ‘সেকালের বাংলা সাময়িকপত্রে জাপান’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় কলকাতার পাশাপাশি বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর থেকে প্রকাশিত অনেক সাময়িকীতে জাপান সম্পর্কে মুদ্রিত অনেক রচনার কথা। উনবিংশ এবং বিংশ শতকের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার বাঙালিরও কম আগ্রহ ছিল না জাপান নিয়ে! ১৯১১ সালে জাপানের আরেকজন খ্যাতিমান বৌদ্ধপণ্ডিত, অভিযাত্রী এবং ওকাকুরা’র ভাবশিষ্য কাওয়াগুচি একাই (১৮৬৬-১৯৪৫) ১৯০১ সালে যখন নিষিদ্ধ তিব্বতে যান তখন চট্টগ্রামের অধিবাসী ব্রিটিশের সরকারি কর্মকর্তা এবং তিব্বত-বিশেষজ্ঞ রায় বাহাদুর শরৎচন্দ্র দাস (১৮৪৯-১৯১৭) তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন। বিশ্বযুদ্ধপূর্ব সময়ে পূর্ব বাংলা থেকেও স্বদেশি আন্দোলনের বিপ্লবী কেউ কেউ জাপানে এসেছিলেন কোনো-কোনো সূত্র থেকে জানা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর অনুষ্ঠিত টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে (১৯৪৬-১৯৪৮) ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণকারী বিচারপতি ড.রাধাবিনোদ পালে’র (১৮৮৬-১৯৬৭) ভূমিকা বিশ্বআলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি গোড়া থেকেই বিজয়ী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আয়োজিত এই ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন এবং অস্বীকার করতে থাকেন। প্রায় আড়াই বছর তিনি টোকিও ইম্পেরিয়াল হোটেলের কক্ষে বিস্তর গ্রন্থ এবং দলিলপত্র গবেষণা করে তাঁর রায় বা অভিমত লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর এই রায় বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধিত্বকারী আর বাকী ১০ জন বিচাপতির থেকে ছিল সস্পূর্ণ ভিন্ন এবং যুক্তিপূর্ণ। তিনি এই ট্রাইব্যুনালকে ‘প্রহসন’, ‘বিজয়ীর বিচার’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করে ট্রাইব্যুনালকে অস্বীকার করেন। যদিও তাঁর এই রায় আদালতে পাঠ করতে দেয়া হয়নি কিন্তু বিভিন্ন সূত্র মারফৎ বিশ্বের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে পরে সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলে। উক্ত ট্রাইব্যুনালকে নাকচ করার ফলে স্বাভাবিক কারণেই জাপানের পক্ষে রায়টি চলে যায় অর্থাৎ পক্ষান্তরে জাপান নির্দোষ বলে প্রতিভাত হয় বিচারপতি পালের রায়ে। প্রকৃতপক্ষে সেইসময় যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে আন্তর্জাতিক কোনো আইন ছিল না যে কারণে এই বিচারের কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি আন্তর্জাতিক আইনবিশেষজ্ঞ বিচারপতি পাল। তবে জাপানের যুদ্ধাপরাধকেও সম্পূর্ণ অস্বীকার করেননি তিনি, জাপানকে দায়ী করেন পাশ্চাত্য সা¤্রাজ্যবাদীকে অনুসরণ করার ভুলভ্রান্তিকে। এবং চীনে যদি জাপানি রাজকীয় সমরবাহিনীর সদস্যরা নিরপরাধ নাগরিককে হত্যা করে থাকে তাহলে হিরোশিমা-নাগাসাকি শহরদ্বয়ে অনুরূপ নিরপরাধ মানুষকে আণবিক বোমাদ্বারা হত্যা করার নির্মমতার জন্য আমেরিকারও বিচার দাবি করেন। এরকম সাহসী অভিমত ব্যক্তকারী বাঙালি তখনও খুবই কম ছিলেন, এখন তো নেই বললেই চলে। বস্তুত বিচারপতি পালের রায়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুক্তিসঙ্গত, নিরপেক্ষ। ফলে বিচারপতি পালের এই বিচক্ষণ অভিমততে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করার জন্যই তাঁর জাপানি একনিষ্ঠ ভক্ত রাজনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক তানাকা মাসাআকি (১৯১১-২০০৬) একটি গ্রন্থ লিখেন ‘পাআরু হাকুশি নো নিহোন মুজাই রোন’ বা ‘ড. পালের জাপান নির্দোষ রায়’ নামে যা দুই দশকের অধিককাল বেস্ট সেলার্স হিসেবে পরিগণিত হয়। শুধু তাই নয়, তানাকা’র উদ্যোগে বিচারপতি পালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মর্যাদাসম্পন্ন হেইবোনশা পাবলিশার কোস্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং শিক্ষাবিদ শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও’র (১৮৭৮-১৯৬১) সহযোগিতায় কানাগাওয়া- প্রিফেকচারের হাকানো নামক শহরে ১৯৭৪ সালে ‘পাল-শিমোনাকা কিনেনকান’ বা ‘পাল-শিমোনাকা স্মৃতিজাদুঘর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। আরও উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৯৭ সালে প্রাক্তন রাজধানী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্গভূমি ‘কিয়োতো’ শহরে অবস্থিত রেইযান গোকোকু জিনজা শিন্তোও ধর্মীয় মন্দিরের শোওয়া নো মোরি উদ্যানে বিচারপতি পালের একটি সুদর্শনীয় স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে ভারত-জাপান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে। অনুরূপ আরও একটি স্মৃতিফলক স্থাপিত হয়েছে টোকিওর ইয়াসুকুনি জিনজার প্রাঙ্গণে ২০০৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৬০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে। আজকে বিচারপতি পাল জাপানে একজন অত্যন্ত সম্মানের পাত্র। সম্ভবত এত সম্মান জাপান আর কোনো বিদেশিকে এই পর্যন্ত প্রদর্শন করেছে বলে আমাদের জানা নেই। ১৯৬৬ সালে জাপানের রাষ্ট্রীয় ‘কোক্কা কুনশোও’ পদকে ভূষিত করা হয়। বলা বাহুল্য, বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল ভারতীয় হলেও তাঁর জন্ম অবিভক্ত ভারতের নদীয়ার সলিমপুর গ্রামে যা এখন বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত। কর্মজীবনে তিনি প্রথম ১০ বছর আনন্দমোহন কলেজে গণিতশাস্ত্রের অধ্যাপনা করেছেন। অনেক জাপানি নাগরিক তা জানেন এবং কুষ্টিয়া ও ময়মনসিংহে গিয়ে নীরবে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন। এই দুটি জায়গায় বিচারপতি পালের দুটি স্মারকভাস্কর্য বাংলাদেশ সরকার স্থাপন করতেই পারে।
প্রকৃতপক্ষে, রবীন্দ্র-ওকাকুরার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং বিপ্লবী রাসবিহারী ও নেতাজির প্রতি জাপানি রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সহমর্মিতাই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার পেছনে কাজ করেছে বললে আদৌ অত্যুক্তি করা হয় না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাপানিদের অপরিসীম সাহায্য-সহযোগিতা, প্রচারণা এবং শরণার্থীদের জন্য তহবিল গঠনের আন্দোলন সর্বজনবিদিত। শুধু তাই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশকে শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপানই প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে ১৯৭২ সারের ১০ই ফেব্রুয়ারি। যুদ্ধোত্তর দেশটিকে পুনর্গঠন করার জন্য জাপান নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। এইসবগুলো ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ হায়াকাওয়া তাকাশি’র (১৯১৬-৮২) ভূমিকা ছিল এককথায় অসামান্য এবং অবিস্মরণীয়।
১৯৭২ সালে জাপানের বহু পুরস্কারে ভূষিত খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা ওওশিমা নাগিসা (১৯৩২-২০১৩) ‘জোই বানগুরা’ বা ‘জয় বাংলা’ নামে ২৫ মিনিটের এবং ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর ‘বেনগারু নো চিচি রাআমান’ অথবা ‘বাংলার পিতা রহমান’ নামে ৭৫ মিনিটের দুটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যা দুদেশের জন্য অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের দারিদ্র্য এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণে গঠন করেন কতিপয় তরুণ-তরুণী ‘শাপলা নীড়’ নামে একটি এনজিও সংস্থা যা আজকে এনপিও হিসেবে এখনো কর্মরত বাংলাদেশে। সেই তরুণদের অন্যতম গ্রাফিক ডিজাইনার ফুকুজাওয়া ইকুফুমি (১৯৫১?-) বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু। অকৃত্রিম বন্ধুদের মধ্যে জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা (১৯৩১-২০১১), বাংলা ভাষা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড.ৎসুয়োশি নারা (১৯৩২-২০১৪), রাজনীতিবিদ এবং জাপান-বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মসচিব ইতোও কেইসুকে (১৯২২-), রাজনীতিবিদ সাকুরাই শিন (১৯৩৩-২০১৭), রাজনীতিবিদ মিৎসুজুকা হিরোশি (১৯২৭-২০০৪), রাজনীতিবিদ ইশিকাওয়া তামোন (১৯৪৩-), মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষদর্শী আন্তর্জাতিক রেডক্রসের বাংলাদেশ.ভিয়েতনাম প্রাক্তন প্রধান, আন্তর্জাতিক পতাকা গবেষক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফুকিউরা তাদামাসা (১৯৪১-) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অসাধারণ এক সংবর্ধনা প্রদান করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তানাকা কাকুয়েই (১৯১৮-৯৩) সরকার যিনি ছিলেন প্রভাবশালী কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ এবং ওকাকুরা’র একনিষ্ঠ ভাবশিষ্য প্যান-এশিয়ানিস্ট। বাংলাদেশের পুনর্গঠন এবং সার্বিক উন্নয়নে জাপানের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন কাকুয়েই তানাকা। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক জাপান সফরের পর ১৯৭৪ সালে তৎকালীন রাজপুত্র বর্তমানে স¤্রাট আকিহিতো (১৯৩৩-) বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছিলেন ফুকিউরা তাদামাসার প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণে জাপানিরা প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হন! হন ক্ষুদ্ধ। বাংলাদেশকে নিয়ে জাপানের স্বপ্নের ভিত উলোট-পালোট হয়ে যায়। সম্প্রতি আবিষ্কৃত ‘বাংলাদেশ নিউজ’ এর একটি সংখ্যায় দেখা যায় জাপানের প্রথম সারির বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সঙ্গে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিল। তথাপি জাপানের সহযোগিতার হস্ত আজও সম্প্রসারিত বাংলাদেশের দিকে। তারই প্রমাণ পাওয়া ২০১৪ সালে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল জাপান সফর। জাপানি প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজোও (১৯৫৪-) বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ৬০০ কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা দেন। এছাড়াও ব্যাপক ব্যবসা-বাণিজ্যের আলোচনা হয়। জাপানের বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে, এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান আগ্রহী। তরুণ নারী উদ্যোক্তা জাপান সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত ইয়ামাগুচি এরিকো’র (১৯৮১-) ‘মাদার হাউজ’ তথা বাংলাদেশে তৈরি হাতব্যাগসহ মহিলাদের ফ্যাশন সামগ্রী জাপানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে না, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে যেমন টোকিওতেই রয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতীক শহীদমিনার, ২০০৫ সালে স্থাপিত। শুধু বাংলাদেশকে নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে দুই দশকের বেশি সময় ধরে ‘সোকা’ বা ‘উযানযাত্রী’ নামে একটি সাময়িকী জাপানি ভাষায় যার প্রতিষ্ঠাতা নারী অনুবাদক ও গবেষক সুজুকি কিকুকো (১৯৪৫-)। বাংলাদেশকে নিয়ে গবেষণা করছেন অধ্যাপক ড.উসুদা মাসাইউকি (১৯৪৪-), প্রাক্তন জাপানি রাষ্ট্রদূত হোরিগুচি মাৎসুশিরোও (১৯৪৩-), অধ্যাপক আনদোও কাজুও (?) প্রমুখ। বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে কাজ করছেন অধ্যাপক ড.নিওয়া কিয়োকো (১৯৫৭-), অধ্যাপক তোগাওয়া মাসাহিকো (?) প্রমুখ। তাছাড়া বহু জাপানি বাংলাদেশ ঘুরে এসে লিখছেন তাদের অভিজ্ঞতা, অভিমত ইন্টারনেটের সাইটগুলোতে যা ভালোলাগার আন্তরিকতায় উষ্ণতর।
জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ যা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা করা কঠিন। প্রবাসীদের কর্মকাণ্ডের ইতিবৃত্তও কম দীর্ঘ নয়! বাংলাদেশীরা বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে এই দেশে যেমন পত্রিকা প্রকাশ, সাহিত্যবিষয়ক সাংগঠনিক তৎপরতা, বৈশাখী মেলা উদযাপন, মহান একুশে উদযাপন, প্রজন্ম ৭১ শিশুদের অনুষ্ঠান ছাড়াও সারা বছরই সাংস্কৃতিক আনুষ্ঠানের আয়োজনে জাপানিদের সমাগম ঘটে থাকে। প্রদর্শিত হচ্ছে বাংলাদেশের ওপর গৃহীত আলোকচিত্র প্রর্দশনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, চিত্রকলা প্রদর্শনী এবং বাণিজ্য প্রদর্শনী। ষাটের দশকে এদেশে শিল্পাচার্য জয়নাল আবেদীনে’র (১৯১৪-৭৬) চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে। নব্বই দশকে ইউনেসকো এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের বিশ্ব প্রতœসম্পদের একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এভাবেই জাপানে বাংলাদেশ উপস্থাপিত হয়ে আসছে বহু যুগ ধরে। অদূর ভবিষ্যতে এশিয়ায় চীনের আগ্রাসনবাদী ভূমিকার কারণে জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করার পরিকল্পনা করছে জাপান সরকার।
জাপান প্রবাসী শিশু সাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক এবং গবেষক
আলোকচিত্র:
১. ১৯১৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রয়াত বন্ধু ওকাকুরা তেনশিনের পরিবারের সঙ্গে
২. ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুকে জাপানে আমন্ত্রণের জন্য ঢাকায় তানাকা মাসাআকি