ঢাকা ডেস্ক : বন্দরনগরী য়োকোহামার ওওকুরায়ামা শহরে রয়েছে একটি অপ্রতীম প্রাসাদোপম গ্রিক হেলেনিক শৈলীর ভবন নাম ওওকুরায়ামা কিনেনকান বা ওওকুরায়ামা স্মৃতিভবন। এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে জাপানের প্রথম আধুনিক আধ্যাত্মিক সংস্কৃতিচর্চার পথিকৃৎ দার্শনিক ড.ওওকুরা কুনিহিকো নির্মাণ করিয়েছিলেন ১৯৩২ সালে। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন কাগজ আমদানিকারক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ওওকুরা য়োশিতেন এর কর্ণধার, পরবর্তীকালে তোওয়োও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। মনেপ্রাণে শিক্ষাব্রতী ওওকুরা কুনিহিকো তাঁর গ্রামের বাড়িতে মেয়েদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছেলেদের জন্য কারিগরি বিদ্যালয় এবং টোকিওতে বিদেশি ছাত্রদের জন্য হোস্টেল স্থাপন করেছিলেন। চেতনার দিক থেকে জাতীয়তাবাদী হলেও আন্তর্জাতিকমনস্ক ছিলেন। বিলেতে গিয়েছিলেন বিশ্বকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। ইংরেজি জানতেন। নিজের রচনাগুলো জাপানি ও ইংরেজিতে মুদ্রিত করে বিনামূল্যে বিতরণ করতেন। ২৫.৫ মিটার উঁচু হলরুম, গ্রন্থাগার, চিত্রপ্রদর্শনীর গ্যালারি, সঙ্গীতচর্চার কক্ষসহ অনেকগুলো কক্ষবিশিষ্ট ত্রিতল ওওকুরায়ামা স্মৃতিভবনটি ছিল তাঁর বাসভবন এবং জাপানের প্রথম আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। এই সালে য়োকোহামা নগর প্রশাসন এটা ক্রয় করে নিয়ে কিছুটা সংস্কার করে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। ১৯৮৪ সালে এর নতুন নামকরণ করা হয় য়োকোহামা-শি ওওকুরায়ামা কিনেনকান নামে যদিওবা এটি ওওকুরায়ামা কিনেনকান নামেই বহুল পরিচিতি। ১৯৯১ সালের ১লা নভেম্বর তারিখে য়োকোহামা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। প্রতিদিন এখানে পিয়ানো শিক্ষা, সংস্কৃতিচর্চা, স্থানীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের সভা, বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার, সঙ্গীতানুষ্ঠান, অঙ্কনচিত্র বা আলোকচিত্র প্রদর্শনী, গ্রন্থাগার পরিদর্শন ইত্যাদির মাসিক-বাৎসরিক উৎসব-অনুষ্ঠানাদি হয়ে থাকে এর সবুজ বাগান জুড়ে। এরকম ভবন জাপানে অদ্বিতীয় বিধায় প্রচুর পর্যটকও আসেন দেখার জন্য।
ড.ওওকুরা কুনিহিকো ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু। ১৯২৯ সালে কানাডা থেকে ফেরার পথে জাপানে বিশ্রাম নিতে কবিগুরু পুনরায় বিরতি নিয়েছিলেন। কানাডা যাওয়ার পথে জাপান হয়েই গিয়েছিলেন। কবি তখন ৬৮ বছর বয়সী। শারীরিকভাবে দুর্বল এবং অসুস্থ। কবিগুরু কানাডা থেকে পুনরায় জাপানে আসছেন এমন সংবাদ পেলেন জাপানপ্রবাসী মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু। কবির জন্য উপযুক্ত একটি আশ্রয় প্রয়োজন। যেখানে তিনি শান্তিতে তাঁর প্রিয় জাপানকে উপলদ্ধি করে মানসিক আনন্দ পাবেন। তেমনি একটি বাসস্থান খুঁজে পেতে যোগাযোগ করলেন তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু ওওকুরা কিুনিহিকোর সঙ্গে। ‘কবিগুরু কানাডা থেকে জাপানে আসছেন তাঁর বিশ্রাম দরকার তাই আপনার শরণাপন্ন হলাম।’ কুনিহিকো এই সংবাদ শুনে সানন্দে রাজি হলেন তাঁর প্রাসাদোপম বাড়ি টোকিওরই মেগুরো শহরে অবস্থিত কবিকে সেখানে অতিথি হিসেবে বরণ করে নেবার জন্য। কবির কথা জানতেন কুনিহিকো কারণ ১৯১৩ সালে এশিয়া মহাদেশে প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জনকারী ব্রিটিশ-ভারতের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংবাদ জাপানি গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। জাপানিদের প্রত্যাশা ছিল তৎকালীন প্রাচ্যের একমাত্র শিল্পোন্নত রাষ্ট্র জাপান থেকেই কোনো না কোনো কবি বা সাহিত্যিক এই পুরস্কার পাবেন। কিন্তু পাননি, রবীন্দ্রনাথের ৫৫ বছর পর সুসাহিত্যিক কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি ১৯৬৮ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘ইউকি গুনি’ বা ‘বরফের দেশ’ এর জন্য। কাওয়াবাতা কৈশোরে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনেছেন এবং প্রভাবিত হয়েছিলেন।
যাহোক, কবিগুরু জাপানে এলেন ভগ্নদেহমনে। কানাডার ভেনকুভার থেকে আমেরিকায় যাওয়ার পথে তাঁর পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেন সফরসঙ্গী সচিব অধ্যাপক অপূর্ব কুমার চন্দ। একসময় ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন বলে জানা যায়। ফলে মার্কিনী অভিবাসন কর্মকর্তা কবির দলকে প্রবেশ করতে তো দেয়ইনি উল্টো অপদস্থ করতেও ছাড়েনি, অথচ নোবালেজয়ী এই কবির নাম আমেরিকাতে অজানা নয় আদৌ। হয়ত কপাল মন্দ ছিল এইযাত্রা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাই এই অপমান এবং ভোগান্তি। অপমানিত হয়ে বিফল মনোরথে কবি শান্তির দেশ জাপানেই ফিরে এসে কিছুদিন কাটাবেন সিদ্ধান্ত নিলেন জাহাজেই। সেই মোতাবেক টেলিগ্রাম করলেন জাপানে তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত রাসবিহারী বসু এবং দোভাষী ও পরমভক্ত মাদাম তোমি কোরাকে। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় মাদাম কোরা এই জাপানেই এবং আমৃত্যু ছিলেন গুরুদেবের ভক্ত (দুজনের সম্পর্ক নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছি এর আগে।
রাসবিহারী বসুর তত্ত্বাবধানে কবি ওওকুরা কুনিহিকোর প্রাসাদোপম বাড়িতে উঠলেন। প্রায় তিন সপ্তাহ ছিলেন এখানে তারপর অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারতেই ফিরে যেতে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। এই তিন সপ্তাহকাল কবি দারুণ খুশমেজাজেই ছিলেন। নতুন বন্ধু কুনিকোর সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল তাঁর। চিন্তাচেতনায় দুজনের মিলে গিয়েছিল অভিমত, মতামত, রুচিবোধ সবই। কবি যাতে আনন্দে থাকতে পারেন তার জন্য আয়োজনের কোনো ত্রুটি রাখেননি কুনিহিকো। কবির পছন্দের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখনকার টোকিওর প্রধান প্রাণকেন্দ্র শিনজুকু শহরের প্রসিদ্ধ ‘নাকামুরায়া’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে অবস্থিত রাসবিহারী বসুর ভারতীয় রেস্টুরেন্ট ‘ইনদো নো মোন’ বা ‘ভারতীয় তোরণ’ থেকে যে সুস্বাদু ‘কারি’ খাবার কবির জন্য প্রেরিত হত তা আর না বললেও চলে! কবি ১৯২৪ সালে এই নাকামুরায়ায় গিয়েছিলেন এবং রাসবিহারী বসুর পরিবারের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন।
কবিগুরু শিশু ও তরুণদেরকে খুব ভালোবাসতেন। তার কারণ বুড়ো বয়সে এদের কাছ থেকে প্রচুর প্রাণশক্তি আহরণ করা যায়। তাই কুনিহিকো তখনকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষারত বিদেশি প্রায় ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রীকে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর বাড়িতে এসে কবিকে সঙ্গ দেবার জন্য। কবিকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পর্যটনে গিয়েছিলেন। পরমভক্ত মাদাম তোমি কোরা কবির বক্তৃতা দেবার ব্যবস্থা করলেন দৈনিক আসাহিশি¤॥^ুন পত্রিকাকে অনুরোধ করেন। আসাহিশিম্বুন মিলনায়তনে এক নাগাড়ে কয়েকদিন পড়ে গেলেন ‘অবসরের দর্শন’ নামক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ। যা কিছুদিনের মধ্যেই কোরাদেবী গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলেন ইংরেজি থেকে জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে। বাংলায় কি এই প্রবন্ধটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল, আমার জানা নেই?
প্রথম সাক্ষাৎকারেই ওওকুরা কুনিহিকোর যে কবিকে অসামান্য ভালো লেগেছিল তার প্রমাণই হচ্ছে অনেকগুলো জাপানি গ্রন্থ তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। সেগুলো ছিল মূল্যবান জাপানের মহাইতিহাসগ্রন্থ, সংস্কৃতিবিষয়ক প্রকাশনা। অবশ্য তাঁর নিজের গ্রন্থ ‘কানসোও’ বা ‘চিন্তা’ কবির করকমলে অর্পণ করেছিলেন। কবিও বন্ধুকে প্রতিউপহার দেবার জন্য মনে মনে ঠিক করেছিলেন। তাই শেষ জাপান ভ্রমণ যা আসলে পঞ্চম ভ্রমণ শেষ করে জাপান ত্যাগ করলেন।
স্বদেশে ফিরে গিয়েই প্রায় দেড়শ বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থ যেগুলো তাঁরই রচিত এবং একটি ভারতীয় নৌকোর মডেল কুনিহিকোকে পাঠালেন।
সেগুলো পেয়ে কুনিহিকো খুব আনন্দিত হয়েছিলেন তার প্রমাণ তিনি গ্রন্থগুলো এবং নৌকোটিকে ওওকুরায়ামা ভবনে অতিযতেœর সঙ্গে
সংরক্ষণ করলেন। এই ভবনের ভেতরে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার তিনি ভবন নির্মাণের সময়ই পরিকল্পনা করেছিলেন। সেটি আজও আছে এবং
আরও সমৃদ্ধতর হয়েছে।
১৯৬১ সাল। বিশ্বব্যাপী গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শততমজন্মবর্ষ উদযাপিত হবে। ভারতে আগেভাগেই পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছে জাপানেও সেটা হোক কারণ ভারতের পর একমাত্র জাপানকেই কবি সবচে বেশি আপন করে ভালোবেসেছিলেন। জাপানে তাঁর প্রচুর ভক্ত, প্রচুর স্মৃতি। তাঁর অনেক গ্রন্থের জাপানি অনুবাদ হয়েছে। রবীন্দ্রভক্ত নেহরুর ইচ্ছের কথা বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র জাদুঘরের পরিচালক ক্ষিতিশ রায়ের চিঠির মাধ্যমে জাপানে এসে পৌঁছালো। ১৯৫৮ সালেই কবির কতিপয় জাপানি ভক্ত যাঁরা ছিলেন তখনকার প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী। তাঁদের অন্যতম ছিলেন শিক্ষাবিদ, প্রকাশক এবং মৃৎশিল্পী শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও। তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রাথমিক একটি সভার আয়োজন করলেন টোকিও কোকুসাইকান ভবনে। প্রায় ৬০ জন সাড়া দিলেন। তাঁরা চিন্তা করলেন খুব ঘটা করে গুরুদেবের জন্মজয়ন্তী উদযাপন করবেন। কারণ ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানের প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী শিল্পচার্য ওকাকুরা (কাকুজোও) তেনশিনের (১৮৬৩-১৯১৩) ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শুধু ওকাকুরাই নয়, একাধিক চিত্রশিল্পী যেমন য়োকোয়ামা তাইকান, হিশিদা শুনসোও, কানজান শিমোমুরা, আরাই কাম্পো, কাৎসুতা শোওকিন, কোসেৎসু নোসু প্রমুখ; আন্তর্জাতিক কবি ও সাহিত্যিক নোগুচি য়োনেজিরোও, পন্ডিত-গবেষকদ্বয় তাকাকুসু জুনজিরোও এবং আনেসাকি মাসাহারু, বৌদ্ধপন্ডিত কাওয়াগুচি একাই, বৌদ্ধভিক্ষু রিয়োহেই কিমুরা বা কিমুরা নিক্কি, জাপানে প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ নারুসে জিনজোও, দৈনিক আসাহিশি¤॥^ুন পত্রিকার মালিক রিয়োহেই মুরায়ামা, শিল্পপতি এবং আধুনিক জাপানের অন্যতম প্রধান শিবুসাওয়া এইইচি, সিল্কবণিক, বিশ্বখ্যাত সানকেইএন বাগানবাড়ির মালিক এবং শিল্পকলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হারা তোমিতারোও, প্রচন্ড প্রভাবশালী কট্টর জাতীয়তাবাদী চিন্তক এবং গুপ্ত রাজনৈতিক সংস্থা গেনয়োশার প্রতিষ্ঠাতা, রাসবিহারী বসু ও হেরম্বলাল গুপ্ত, ড.সান-ইয়াৎ সেন প্রমুখের রাজনৈতিক আশ্রয়দাতা গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু প্রমুখের বন্ধু কবির জন্মবর্ষ যেনতেন প্রকারে করলে চলবে কেন? তাছাড়া ভারত সরকার থেকে সরাসরি এসেছে অনুরোধ! তাই তাঁরা শরণাপন্ন হলেন শিল্পপতি কাগজ ব্যবসায়ী ওওকুরা কুনিহিকোর কাছে। কুনিহিকো এই প্রস্তাব পেয়ে বিনাবাক্যে রাজি হলেন। ৩০ বছর পর ভারতের কবিবন্ধুকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে সানন্দে উদ্যোগ গ্রহণ করলেন সঙ্গেসঙ্গেই। ১৯৫৯ সালে গঠন করলেন প্রায় শতাধিক বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পী, ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে ‘টেগোর মেমোরিয়াল এসোসিয়েশন।’ হাতে নিলেন বিশাল এক পরিকল্পনা। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে নানাবিধ আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ জাপানে যার তুলনা কবির জন্মস্থান ভারতেও খুঁজে পাওয়া অসম্ভব! এককথায় বিরল ঘটনা! এই সময়কার বিস্তর প্রকাশনাই প্রমাণ করে যে, যুদ্ধপূর্ব ও পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ জাপানের সমাজে কেমন প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, ছিলেন জনপ্রিয়! বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছিল এই অনুষ্ঠানে। বিস্ময়কর অজানা সেসব তথ্যাদি নিয়ে আমি একাধিক প্রবন্ধ ইতিমধ্যেই লিখেছি। ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক’ গ্রন্থে সেসব কিছু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অনুজপ্রতীম বন্ধু লেখক ও সাংবাদিক পিআর প্ল্যাসিড তার বিবেকবার্তা প্রকাশনী থেকে। আমাকে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে।
এই ওওকুরায়ামা ভবনে কবির শতবর্ষ জন্মজয়ন্তীর আলোচনা সভা ও নানা কাজ হত অবশ্য টোকিওর মেজিরো শহরেও একটি দপ্তর স্থাপন করা হয়েছিল। এই ভবনের একটি কক্ষে রবীন্দ্র স্মৃতিকক্ষ উদ্বোধন করেছিলেন কুনিহিকো। রবীন্দ্রনাথের একাধিক আলোকচিত্র এবং গ্রন্থগুলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। এই বাসভবনেই ১৯৫২ সালে রবীন্দ্রভক্ত বাংলাদেশে জন্ম ভারতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত টোকিও ট্রাইব্যুনালখ্যাত বিচারপতি ড.রাধাবিনোদ পাল প্রাচীন ভারতীয় আইন ও দর্শন বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, আয়োজন করেছিলেন তখনকার ওওকুরায়ামা আধাত্মিক সংস্কৃতি কেন্দ্রের পরিচালক শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও। শিমোনাকার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন বিচারপতি পাল। বিচারপতি পালকে নিয়ে আমি একাধিক প্রবন্ধ লিখেছি। উল্লেখ্য যে, শিমোনাকা ছিলেন জাপানের আধুনিক প্রকাশনা সংস্থা হেইবোনশা পাবলিশার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার। তাঁর বিপুল অবদানের কারণে তাঁকে আধুনিক জাপানি প্রকাশনার জনকই বলা যায়। তার প্রতিষ্ঠিত হেইবোনশা কোম্পানির সহোদও প্রতিষ্ঠান ফটো প্রিন্টিং কোম্পানিতে আমি কয়েক বছর কাজ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। এই কাজ করার সুবাদে আমি দুটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পাই একটি পাল-শিমোনাকা কিনেনকান এবং ওওকুরায়ামা কিনেনকান। দুখানেই বিস্তর দলিলপত্র আমি খুঁজে পাই বিচারপতি পাল এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কিত যা বৃহত্তর বাঙালির কাছে অজানা।
২০১১ সাল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতজন্মবর্ষ। অবশ্য শতবর্ষের মতো ঘটা করে কোনোখানেই উদযাপিত হয়নি। ভারতেও নয় জাপানেও নয়। তবু জাপানে এক বছরের পরিকল্পনা নিয়ে আমরা কয়েকজন মাঠে নেমেছিলাম। জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমার জীবদ্দশায় জাপান-বেঙ্গল এসোসিয়েশন গঠন করেছিলাম তাঁকে কেন্দ্র করে ২০০২ সালে। সেই সংস্থার আমি একজন পরিচালক আর কর্মসচিব য়োকোহামাবাসী শ্রীমতী ওওবা তামিকো। আমি এবং ওওবাসান মিলে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করলাম কবিগুরুর সার্ধশতজন্মবর্ষ উদযাপন করার। একাধিক সভা করলাম। ধীরে ধীরে বেশ কয়েকজন প্রবীণ ও নবীন রবীন্দ্রভক্ত উৎসাহিত হয়ে জড়ো হলেন। উদযাপন পরিষদ গঠিত হল তার প্রধান নিযুক্ত হলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু চিত্রশিল্পী কাম্পো আরাইয়ের দৌহিত্র ব্যবসায়ী কাওয়াই ৎসুতোমু। নানা পরিকল্পনা গৃহীত হল। শুরু হওয়ার কথা ছিল এপ্রিল মাসে কোবে শহরে যেখানে রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে প্রথম জাপানের মাটি স্পর্শ করেছিলেন । কিন্তু মার্চ মাসে মহাভূমিকম্পে পরিকল্পনা টাল খেয়ে খেল। শুরু করতে হল জুন মাসে।
যখন নানা পরিকল্পনা গৃহীত হচ্ছিল একদিন কয়েকজন সদস্যকে আমি নিয়ে গেলাম ওওকুরায়ামা কিনেনকান ভবনে। সেখানকার অন্যতম প্রধান গবেষক উচিকোশিসান আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন হাসিমুখে। ১৯৯৯ সালে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এখানে যখন রবীন্দ্রনাথের দলিলপত্র খুঁজতে যাই। আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রেরিত গ্রন্থগুলো নিয়ে আলোচনা করি। আমি তো আগেই দেখেছি কিন্তু এঁরা জানতেন না কিছুই এই সম্পর্কে। বইগুলো, নৌকোর মডেল এবং রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছবি দেখে বিস্মিত হন! রতœখনি আবিষ্কার করে তার ওপর হামলে পড়লেন যেন তাঁরা! বিশেষ করে কাওয়াইসান–যার দাদু আরাই কাম্পোর সঙ্গে ছিল রবীন্দ্রনাথের গভীর বন্ধুত্ব। জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা ভবন এবং শান্তিনিকেতনে জাপানি চিত্রশিল্প শিক্ষা দিয়েছিলেন ১৯১৭-১৮ সালে।
মাঝেমাঝে ভাবি কবিগুরুর দু’শততম জন্মবর্ষ দেখার সৌভাগ্য আমার হবে না। কিন্তু যদি জাপানে উদযাপিত হয়, তাহলে এই ছবি এবং
লেখাগুলো নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ আয়োজকদেরকে অনুপ্রাণিত করবে, আনন্দ দেবে। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের প্রায় পৌণে শতাব্দী বছর পরেও
যখন তাঁকে অতিক্রম করতে পারেনি কোনো বাঙালি কবি, সাহিত্যিক বা দার্শনিক, তখন ধরে নিতেই হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও ২০০ বছর
বাঙালি জাতিকে ক্রমাগত প্রভাবিত করে রাখবেন। কাজেই বাঙালিমানসে যতদিন রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকবেন ততদিন আমার সামান্য এই
কাজগুলোও স্মৃত হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গবেষকদের কাজে লাগবেÑÑএই ভাবনা আমাকে কেবল উজ্জীবিতই করে প্রতিদিন।
জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক