শাহ মামুনুর রহমান তুহিন: ২০১৮ সালের আগষ্ট মাসের ২ তারিখে সারা দেশে চলছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। ঢাকা শহর একেবারেই অচল। এরই মাঝে প্রায় তিন ঘন্টা সাক্ষাতকার ভিত্তিক আলোচনা করেছিলাম আব্দুস সালাম মুর্শেদীর অফিস এনভয় টাওয়ারে। এর পূর্বে এক দুইবার আলোচনা হলেও সেদিন তার কাজের ফাকে ফাকে এ সাক্ষাতকার ছিলো অনেক আন্তরিক পরিবেশে এবং যথেষ্ট সময় নিয়ে। প্রতিবেদক সামাজিক সংগঠন গ্লোবাল খুলনার আহবায়ক এবং নিহন বাংলা ডট কমের উপদেষ্টা সম্পাদক ও বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান। গ্লোবাল খুলনা মুলত: দেশে এবং বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী খুলনার মানুষদের প্লাটফর্ম, যারা খুলনার বিভিন্ন উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার চেষ্টা করছে। আর তাই চেষ্টা করছে, খুলনার যারা সফল মানুষ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সফলতা, অর্জন এবং এই অবস্থানে পৌছানোর জন্য তাদের শ্রম, ত্যাগ এবং অধ্যাবসায় বা সফলতার মূলমন্ত্র সকলের সামনে তুলে আনার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। সাথে সাথে মানুষ যাতে উতসাহিত হয় সে কারনেই এই আলোচনা বা সাক্ষাতকার। এটি বিভিন্ন সফল মানুষদের নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে চলবে। এছাড়াও আর একটি উদ্দেশ্য হলো, সেই সফল মানুষদেরকে খুলনা মুখী কার্যক্রমের ব্যাপারে আগ্রহী করানো। সালাম মুর্শেদীর সাথে পূর্ব থেকে ব্যক্তিগত সখ্যতা, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক বা কোন ধরণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যোগাযোগ কখনো ছিলোনা। কিন্তু যে আন্তরিকতা তিনি দেখিয়েছেন, তা সত্যিই মুগ্ধ করার মতো। সাক্ষাতকারটি আরো আগে ছাপানোর ইচ্ছা থাকলেও অপেক্ষা করছিলাম তার তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুটা দেখার জন্য। বিভিন্ন আলোচনায় দ্বিধাহীন ভাবে তিনি বলেছেন, কোন রাখঢাক না করেই। ছোটবেলা থেকে আজকের অবস্থান তৈরিতে যে শ্রম, ত্যাগ, অধ্যাবসায়, সহযোগীতা, সর্বোপরি ভাগ্য তাকে যে সহায়তা করেছে, তা তিনি খোলা মনেই স্বীকার করেন। স্কুল শিক্ষক বাবা অত্যন্ত সততার সাথে চেষ্টা করেছেন, সংসারের হাল ধরে শিক্ষা, দীক্ষা, উতসাহ দিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করার। সচ্ছলতা ছিলোনা তেমন। তাই রেশনের সামগ্রী দিয়েই পরিবারের খাওয়া দাওয়ার একটি অংশ মিটিয়েছেন। সাইকেল চালিয়ে খুলনায় আসতেন সালাম, খেলা এবং অন্যান্য প্রয়োজনে। তখন রুপসা নদীতে ফেরী এবং নৌকা দিয়ে পারাপার করতে হতো। নৌকা অবশ্য এখনো আছে। সে সময় শুধুমাত্র পঞ্চাশ পয়সা বাচানোর জন্য নৌকায় পার না হয়ে অপেক্ষা করেছেন ফেরীর জন্য। কারণ বিনে পয়সায় পার হওয়া যায় ফেরীতে। হ্যা এটি রুপকথা নয়, বাস্তব কাহিনী একজন দেশসেরা ফুটবালার একজন অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী এবং অল্প কয়েকদিনের মধ্যে যার নতুন পরিচয় হবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের একজন সংসদ সদস্য বা আইন প্রণেতা হিসেবে। সাক্ষাতকার নেবার সময়েই তিনি সদ্য রাজনীতিতে যোগদান করেছিলেন। খুলনাতে বিভিন্ন আলোচনা, সমালোচনা পুরোদমে চলছে। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনাকে নিয়ে তো বিভিন্ন আলোচনা এবং সমালোচনা চলছে। আপনার অভিমত কি এ ব্যাপারে? তিনি খুব শান্তভাবে হাসিমুখে বলেছিলেন, “ভাই সবই জানি। কিন্তু এ বিষয়ে আমি খুব একটা বিচলিত বা দু:শ্চিন্তাগ্রস্থ নই। অথবা সমালোচকদের বিরুদ্ধেও কোন অভিযোগ নেই। কারো বিরুদ্ধে সমালোচনা করার আগ্রহটুকু ও নেই আমার। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন, সম্মান, প্রতিষ্ঠা অনেক অনেক দিয়েছেন। এখন যদি তিনি তৌফিক দেন, তবে খুলনার জন্য কিছু করতে চাই, আমার অভিজ্ঞতা গুলিকে কাজে লাগিয়ে”। আর সমালোচনা শুধু নয়, গালি গালাজ ও তো কম দেয়নি মানুষ। সেই খেলার মাঠ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন করার সময়ে। কিন্তু একসময় তারাই আমাকে বাহবা দিয়েছে। সে সময় যদি সমালোচনায় দমে যেতাম অথবা পালটা জবাব দিতে যেতাম। তাহলে হয়তো আজকের সালাম মুর্শেদী তৈরি হতোনা। ব্যাক্তিগত ভাবে অত্যন্ত ধার্মিক তিনি। প্রশ্ন করেছিলাম, এতো ষ্ট্রেসের পরেও নিজেকে শান্ত রাখেন কিভাবে? সাবলীল উত্তর, “তখন চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করি আমার সেই পুরানো দিনের কথা, কষ্টের দিনের কথা। খুব বেশী ষ্ট্রেস হলে নামাজ পড়ি”।
গ্লোবাল খুলনার শিক্ষা ও শিল্প নগরী গড়ার স্লোগানের প্রতি তিনি সম্পূর্ণ একমত। কারণ শিক্ষাই পারে একটি জাতিকে সঠিক ভাবে গড়ে দিতে। কথা দিয়েছেন, খুলনা গড়ার কাজে যথাসাধ্য ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবেন। তার জীবনকে সফলতার তিন অধ্যায় হিসাবে মুল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি। আর তার সফলতার তৃতীয় অধ্যায়টি ও শুরু হলো সফলতা দিয়ে। এখন অপেক্ষা দেখার জন্য তিনি এই অধ্যায়ে কতটুকু সফল হতে পারেন?
সালাম মুর্শেদীর জন্ম ১৯৬০ সালের ৬ অক্টোবর খুলনার রূপসা উপজেলার নৈহাটি গ্রামে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাল্যকাল এবং বেড়ে ওঠা খুলনা শহর থেকে দুই কিলোমিটার দূরের এই গ্রামেই। শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি নৈহাটি হাইস্কুলে। এ স্কুল থেকেই ১৯৭৬ সালে এসএসসি এবং ১৯৭৮ সালে খুলনা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তবে লেখাপড়ার মাঝপথেই খেলাধুলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বাবা মরহুম মো. ইসরাইল স্কুলশিক্ষক ছিলেন। তিনি একসময় ফুটবল খেলতেন। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে সালাম সবার ছোট। এছাড়া তার পরিবারে স্রী শারমিন সালাম,এবং এক কন্যা ও দুই পূত্র সন্তান রয়েছে। সন্তানদেরও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন।
প্রথম অধ্যায়: খেলাধুলায় সফলতা।
বড় ভাই জামাল উদ্দিন হায়দার খুব ভালো ভলিবল খেলতেন। ততকালীন ইস্ট পাকিস্তান ভলিবল দলে তিনি খেলতেন নিয়মিত। মেজো ভাই কামাল উদ্দিন হায়দার ও ভালো ফুটবল খেলতেন। আর সেজো ভাই আজাদ আবুল কালাম ছিলেন দেশসেরা বডিবিল্ডিং ও ভারোত্তোলন খেলোয়াড়। সালাম মুর্শেদী এবং তার ভাই আজাদ আবুল কালাম দুজনেই জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছিলেন। একজন ফুটবলে এবং আরেকজন ভারোত্তোলনে। ছোটবেলা থেকেই সালাম ফুটবল ছাড়াও একজন ভালো অ্যাথলেট ছিলেন এবং জেলা পর্যায়ে ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে অনেকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ক্রীড়ামোদি পরিবারের উতসাহ আর অনুপ্রেরনায় তিনি হতে পেরেছিলেন দেশসেরা ফুটবলার। আর এই ফুটবল থেকেই তার জীবনের সব কিছু পাওয়া। ক্লাস সিক্সে পড়াকালীনই সবকিছু ফেলে ফুটবলকে বেছে নিয়েছিলেন। তার প্রথম ক্লাব ছিল খুলনা ফার্স্ট ডিভিশনের ইয়াং বয়েজ ক্লাব। এরপর খুলনা আজাদ বয়েজের হয়ে দুই বছর এবং ইয়ং মুসলিম ক্লাবে খেলেন। এখন যেটি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। এর মধ্যে দুই বছর চাকরি করেন, খুলনা প্লাটিনাম জুট মিলে অফিসার পদমর্যাদায়। এবং ওই দুই বছর প্লাটিনাম জুট মিলের হয়ে খেলেন। আসলে প্রত্যেক মানুষকেই বড় হতে হলে স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্ন না থাকলে কখনই বড় হওয়া যায় না। তিনি প্রথম ঢাকায় গিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালে। খুলনা বিভাগীয় দলের হয়ে প্রথম ঢাকায় খেলতে যাওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে প্রথম খেলতে নেমেই তার ভাগ্য খুলে যায়। কারন ওই দিনের খেলা মাঠে দেখছিলেন ঢাকা আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব কর্মকর্তারা। সেদিন তার খেলা দেখে আজাদ স্পোর্টিং কর্তারা মুগ্ধ হয়েছিলেন। এরপর ১৯৭৭ সালে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব তাকে তাদের দলে নেয়। আজাদ স্পোর্টিং তখন খুব একটা ভালো ফর্মে ছিলোনা। লীগে তারা প্রায় সব ম্যাচেই হারত। সালাম ওই ক্লাবে যোগদানের আগ পর্যন্ত সাতটি ম্যাচ খেলে ছয়টিতেই হেরেছিল আজাদ। তখন আবাহনী, মোহামেডানের মতো রহমতগঞ্জ ও ছিলো অন্যতম সেরা দল। আজাদ স্পোর্টিংয়ের হয়ে তার প্রথম ম্যাচ ছিলো রহমতগঞ্জের বিপক্ষে। ঢাকার লীগে প্রথম ম্যাচ, এছাড়াও তখন ইউসুফ, শাহাবুদ্দিন, মোতালেব, হাসান, কালা, আলা সহ অনেক নামিদামি ফুটবলার খেলতেন রহমতগঞ্জে। এত বড়মাপের খেলোয়াড়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে প্রথম মিনিটেই তিনি রহমতগঞ্জের বিপক্ষে গোল করেছিলেন। এবং ওই ম্যাচ ২-১ গোলের ব্যবধানে জিতেছিলেন। ম্যাচ জেতার পরই তিনি শিরোনামে চলে আসেন, কারণ এসেই গোল। এমনকি পরের ম্যাচ ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিপক্ষেও তিনি গোল করেছিলেন এবং সে ম্যাচেও জিতেছিলেন। এভাবেই সেদিন আজাদ জয়ের ধারায় ফিরে আসে এবং আবাহনী-মোহামেডানসহ সব বড় দলকে চ্যালেঞ্জে ফেলে দেয়। এভাবেই ঢাকায় তার খেলোয়াড়ি জীবন শুরু। আজাদ স্পোর্টিংয়ে খেলার সময়েই ১৯৭৭ সালে জাতীয় যুবদলে সুযোগ পেয়ে যান। এরপর ১৯৭৮ সালে জাতীয় দলে। ১৯৭৯ সালে খেলেন বিজেএমসিতে। এরপর ১৯৮০ সালে মোহামেডান ক্লাবে যোগদান এবং ১৯৮৭ সালে খেলা থেকে অবসর নেয়া পর্যন্ত খেলোয়াড়ি জীবনের বাকি দিনগুলি কেটেছে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান ক্লাবে। তিনি অনেকবার মোহামেডানকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জাতীয় লিগে ১৯৮২ সালে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ২৭ গোলের রেকর্ডও তার দখলে। এখনও পর্যন্ত সে রেকর্ড কেউ ভাংতে পারেনি। এর আগে ২৪টি গোল করে এ রেকর্ড ছিল বর্তমান বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের দখলে। মোহামেডানের হয়ে শেষ ম্যাচেও তিনি গোল দিয়েছিলেন এবং শেষ ম্যাচটিও জিতেছিলেন। অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচে তিনি বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন সালাম মুর্শেদী। ফুটবল তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তাই তিনি ফুটবলকেও কিছু দিতে চান। আজীবন তিনি ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান এবং একটি ফুটবল একাডেমিও গড়তে চান। ফুটবল থেকে অবসর নিলেও এখনো তিনি ফুটবলের সংস্পর্শেই আছেন। দেশের অনেক তরুণ ও মেধাবী ফুটবলার উঠে আসার পেছনে তার অবদান রয়েছে। মোহামেডান ক্লাবের উন্নয়নেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তরুণ ও মেধাবী খেলোয়াড়দের উঠিয়ে আনার স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ের ‘জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার’ ও পেয়েছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায়: ব্যবসায়ে সফলতা।
বাবা-মায়ের দোয়া, স্ত্রী শারমিন সালাম এবং দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার কুতুবউদ্দিন আহমেদের সহযোগীতায় তিনি ফুটবলার থেকে বাংলাদেশের একজন সফলতম ব্যবসায়ী হতে পেরেছেন, এ কথা অকপটে স্বীকার করেন তিনি সবসময়। তার স্ত্রী সন্তান ও সংসার সামলে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তাই নয়, অনেক ত্যাগও স্বীকার করেছে। দীর্ঘ সময় কাজে ব্যস্ত থাকলেও আমার স্ত্রী কখনই রাগ দেখাত না এবং ছিলোনা কোন সন্দেহ বা অভিযোগ। তার ভাষ্যমতে, “আমি মনে করি একটা মানুষের জীবনের সফলতার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান থাকে তার জীবনসঙ্গিনী বা স্ত্রীর”। এছাড়া তিনি যখন মোহামেডানে খেলতেন তখন থেকেই তার সঙ্গে পরিচয় হয়, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কুতুবউদ্দিন আহমেদ সাহেবের সংগে। তিনি তখন চাকরি করতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন খুবই খেলাভক্ত মানুষ। তিনি তখন মোহামেডানের ব্যাডমিন্টন টিমটি চালাতেন এবং মোহামেডানের প্রত্যেকটা ফুটবল ম্যাচে মাঠে উপস্থিত থেকে খেলা উপভোগ করতেন। তার সঙ্গে সখ্যতা এবং এরই এক পর্যায়ে ব্যবসায়ের প্রস্তাব দিলেন কুতুবউদ্দিন। এভাবে আলোচনার এক প্রেক্ষিতে ব্যবসা শুরু করে দিলেন। শুরু হলো সফলতার দ্বিতীয় অধ্যায়। দু’জনে মিলে এনভয় পরিবার গড়ে তুলেছেন। শূন্য থেকে ব্যবসা করে বাংলাদেশের অন্যতম বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহ গড়ে তুলেছেন। ১৯৮৫ সালে রাজধানীর ৪০০/বি, খিলগাঁওয়ে ‘এনভয়’ নামে গার্মেন্টস কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন তারা। মাত্র ৪৫টি মেশিন এবং ২০০ শ্রমিক-কর্মচারী দিয়ে ব্যবসার যাত্রা শুরু। ব্যবসা শুরুর পর তাদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। খিলগাঁওয়ের ৪০০/বি’র যে বাড়িতে প্রথম কারাখানাটি স্থাপন করা হয়েছিল সেটি আজও আছে। সেখান থেকে এখন এনভয় গ্রুপের শুধু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিই রয়েছে মোট ১৫টি। এই কারখানাগুলো হচ্ছে এনভয় গার্মেন্টস লিমিটেড, এস্ট্রাস গার্মেন্টস, ইপোচ গার্মেন্টস, আরমোয়ার গার্মেন্টস, পাস্তেল অ্যাপারেলস, মানতা অ্যাপারেলস, এনভয় ডিজাইন, নাদিয়া গার্মেন্টস, রিগাল গার্মেন্টস, সুপ্রিম অ্যাপারেলস, ডর্নিক অ্যাপারেলস, ফন্টিনা ফ্যাশন, এনভয় ফ্যাশন এবং ওলিও অ্যাপারেলস। এসব কারখানা থেকে বিশ্বের নামিদামি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পোশাক কিনে থাকে। বড় বড় কয়েকটি বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ওয়ালমার্ট, জারা, রিগাটা, ওকায়দি, নেক্সট, এমঅ্যান্ডএস প্রভৃতি। এনভয় টেক্সটাইল মিল গড়ে তোলা হয়েছে ৪৮ একর জায়গার ওপর, যেটি বাংলাদেশের প্রথম রোপ ডায়িং প্ল্যান্ট। এ কারখানার ডেনিম ব্র্যান্ডের কাপড় ইউরোপ, তুরস্ক, ভারত এবং শ্রীলঙ্কায় রফতানি করা হয়। ২০০১ সালে পোশাক শিল্পের বাইরে গড়ে তোলা হয় আইটি কনসালটেন্ট সেন্টার। এই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ডের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করে। ন্যাশনাল সিস্টেম সলিউশন নামের প্রযুক্তি খাতের আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে এনভয় গ্রুপ। এই গ্রুপের আরেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান শেলটেক। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আবাসন খাতের শিল্প প্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছে। প্লাটিনাম স্যুইট নামের এই শিল্প গ্রুপের রয়েছে হোটেল ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে ২০০৯ সালে। ট্রেডিং ডিভিশনে রয়েছে লুনার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং ইমারেল্ড ট্রেডিং লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৮ সালে গড়ে তোলা হয় পিনাতা এয়ার ইন্টারন্যাশনাল এবং ওআইএ গ্লোবাল লজিস্টিক্স (বিডি) লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান দুটি। এই গ্রুপেরই আরেক শীর্ষ প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড। যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে ৩০টির অধিক ব্রাঞ্চ রয়েছে। এর বাইরে দেশের অন্যতম এই শীর্ষ গ্রুপটি তাদের স্পিনিং প্ল্যান্টের উত্পাদন ক্যাপাসিটি প্রতিদিন ৪০ টনে উন্নীতকরণের কাজ করছে। এ ছাড়া ডেনিম টেক্সটাইল কারখানার বাত্সরিক উতপাদনক্ষমতা ২২ মিলিয়ন থেকে বাড়িয়ে ৪০ মিলিয়ন ইয়ার্ড করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। প্রতিদিন ২০ হাজার পিছ অটোমেটেড জিনস উতপাদন এবং ওয়াশিং প্ল্যান্টের উতপাদন বাড়িয়ে ৩০ হাজার পিচ করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এনভয় গ্রুপের বর্তমানে মোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ২৭টি। ২০০ লোকের জায়গায় এখন এ গ্রুপে চাকরি করছেন প্রায় ২২ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। গ্রুপের বর্তমান বার্ষিক টার্নওভার ২০০ মিলিয়ন ডলারের ও বেশি। রেডিমেড গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এনভয় গ্রুপকে শীর্ষস্থানীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এজন্য স্বীকৃতি স্বরুপ তারা জাতীয় রপ্তানি ট্রফি এবং রাষ্ট্রপতি রপ্তানি ট্রফি ও পেয়েছেন। এ সব কিছু সম্ভব হয়েছে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশ পোষাক তৈরি ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ‘বিজেএমইএ’এর অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন সালাম মুর্শেদী। এই সংগঠন ও গার্মেন্টস শিল্পের প্রতি তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ, তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি টানা চারবার বিজেএমইএ এর পরিচালক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কখনো কখনো ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেছেন। সফলতার সাথে বিজেএমইএ’ এর প্রেসিডেন্ট পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দায়িত্ব পালন করছেন, এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি হিসেবে। ব্যবসায়ী হিসেবেও পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। ব্যবসায়ী হিসেবে হয়েছেন সিআইপি (কমার্শিয়ালি ইমপর্ট্যান্ট পারসন)। ২০১৭ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে পেয়েছেন সর্বোচ্চ খেতাব ‘কর বাহাদুর সম্মাননা’। দেশের মানুষ তাকে এক নামে চেনে। সবদিক দিয়ে বলা যায়, তার জীবনে অসম্পূর্ণ বলে কিছু নেই। তবে কারও যদি চেষ্টা থাকে এবং কোনো কিছু নিয়ে লেগে থাকে তাহলে সফল হওয়া যাবেই।
তৃতীয় অধ্যায়:রাজনীতিতে সফলতা।
এক সময়ের ফুটবলের মাধ্যমে মাঠ কাঁপিয়ে, অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী হিসাবে নিজেকে প্রমান করার পর আব্দুস সালাম মুর্শেদী এবার ঝড় তুলছেন রাজীনিতির মাঠে। দেশ সেরা এ স্ট্রাইকার ও ব্যবসায়ী আগামী খুলনা-৪ আসনের উপ-নির্বাচনে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে যাচ্ছেন। রাজনীতিতে একেবারেই নতুন মুখ হলেও রাজনৈতিক পরিবেশে চলা ফেরা, রাজনৈতিক কূট কৌশল কমবেশি জেনে ফেলেছেন এতোদিনে। কারন ক্লাব পর্যায় থেকে বাফুফে, ব্যবসায়ীদের সংগঠন এবং সবখানেই তিনি সফল হয়েছেন দারুণভাবে। অনেকে সমালোচনা হয়তো করছেন, আজীবন মোহামেডান ক্লাবে খেলা সালাম মুর্শেদী নৌকার হাল ধরার কারনে বিরোধী শিবিরে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। কেউ কেউ বলছেন, এক সময়ে বিরোধী দলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে আসা যাওয়া করা (বিএনপির ক্ষমতায় থাকাকালীন) বিশিষ্ট শিল্পপতি সালাম মুর্শেদী, নৌকার দক্ষ মাঝি হিসেবে কতটা শক্ত হাতে হাল ধরতে পারবেন? সেটাই এখন মুলত: দেখার বিষয়। কিন্ত তিনি তার স্বভাব সুলভ গতিতে ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছেন, কোন সমালোচনাকে গায়ে না মাখিয়ে। এমনকি কোন প্রতিবাদ বা কাদা ছোড়াছুড়িতে অংশ ও নিচ্ছেন না। প্রসংগত: চলতি বছরের ৩ মার্চ খুলনা সার্কিট হাউজের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন সালাম মুর্শেদী। প্রধানমন্ত্রীর খুলনার সেই জনসভায় তারকা ফুটবলার ও ব্যবসায়ী সালাম মুর্শেদী ভোটযুদ্ধে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিজানকে দুর্নীতি দমন কমিশনে তলব করার পর সবাই ধারণা করেছিলেন সালাম মুর্শেদী এই আসনের আ’লীগের প্রার্থী হবেন। কিন্ত রাজনীতিতে নেমেই তিনি এমন সুযোগ পেয়ে যাবেন, তা তিনি নিজেও কখনো কল্পনা করেননি। গত ২৬ জুলাই খুলনা-৪ (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া) আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা রশিদী সুজা দীর্ঘদিন কিডনি রোগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ায়, তার আসনটি শূন্য হয়। অনেকে ধারনা করেছিলেন, তার একমাত্র ছেলে জেলা পরিষদ সদস্য , খালেদীন রশিদী সুকর্ণ অথবা সাবেক সচিব ও বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা বর্ষিয়ান ড. মসিউর রহমান সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পাবেন। কিন্তু ফুটবলের দেশসেরা ষ্ট্রাইকার, ব্যবসায়ে এবং বিভিন্ন সংগঠনে সফলতা পাওয়া আব্দুস সালাম মুর্শেদীকে খুলনা-৪ আসনের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। অর্থাৎ এখানেও তিনি পেলেন শুরুতেই সাফল্য। কারন আওয়ামীলীগের কয়েকজন ছাড়াও ভিন্ন রাজনৈতিক দলের দুজন মনোনয়ন কিনেছিলেন, কিন্তু তারা মনোনয়নপত্র জমা না দেওয়ায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে চলেছেন সালাম মুর্শেদী। অর্থাৎ শুরুতেই গোল। তবে তিনি বলেছেন, “রাজনীতির মাঠে নতুন হলেও প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সফল হওয়ার চেষ্টা করবো”।
তথ্য উপাত্ত সমূহ সালাম মুর্শেদীর সরবরাহকৃত।