জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশি শিশুকিশোর ও অভিভাবকদের প্রতীক্ষিত একটি দিন আনন্দ–উচ্ছ্বাস আর ভালো লাগার রেশ রেখে শেষ হয়ে গেল। গত রোববার (৬ মে) ছিল জাপানের গোল্ডেন উইক ছুটির শেষ দিন। এই দিনে নির্দিষ্ট ছিল প্রবাস প্রজন্মের নবম আয়োজনের। এতে মেতে ছিলেন প্রবাসীরা। জাঁকজমক অনুষ্ঠানে বিকেল চারটা থেকে রাত নয়টা, টানা পাঁচ ঘণ্টা জুড়ে ছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন।
টোকিওর কিতা ওয়ার্ডের তাকিনাগাওয়া কাইকানের হলভর্তি দর্শক পুরো সময়টাই যে উপভোগ করেছেন সেটা অনুষ্ঠান শেষের পরও প্রবাসীদের আড্ডা ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচার দেখে বোঝা গেছে। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ। তাঁকে এ বছরের প্রবাস প্রজন্ম সম্মাননা (২০১৮) দেওয়া হয়। এ ছাড়া জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশিদের পরম বন্ধু ও মানবাধিকার কর্মী এশিয়ান পিপলস সোসাইটির (এপিএফএস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইয়োশিনারি কাতসুওকে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়। তাঁদের হাতে এ সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরুর প্রাক্কালে জাপানে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আশরাফ–উদ–দৌলার সভাপতিত্বে আয়োজকদের পক্ষ থেকে স্বাগতিক ও শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন রাহমান মনি। অভিভাবকদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ড. তপন কুমার পাল। এ ছাড়া সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন এপিএফএসের বর্তমান সভাপতি ইয়শিদা মায়োমি, রাবাব ফাতিমা, আশরাফ–উদ–দৌলা, জাপানের নিউ কোমেইতো পার্টির নীতি নির্ধারক সাবেক মন্ত্রী অতা আকিহিরো ও জাপান ফরেন প্রেস সেন্টারের সভাপতি আকাসাকা কিয়োতাকা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রাজনীতিবিদ ছাড়াও জাপানি ও প্রবাসী বাংলাদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
অর্ধশতাধিক শিশুকিশোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। তাদের পরিবেশনা দেখে বোঝার উপায় ছিল না তারা ভিন্ন দেশে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ছাড়াও এ উপলক্ষে আয়োজিত শিশু–কিশোরদের চিত্রকলা প্রদর্শনী ও পুরস্কার বিতরণ করা হয় অনুষ্ঠানে। দুটি বিভাগে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। চিত্রশিল্প প্রদর্শনীটি ছিল এযাবৎকালের সবচেয়ে আকর্ষণীয়। গ্যালারিতে শিশুরা নিজেদের আঁকা ছবি দেখে খুশি হয়।
প্রবাস প্রজন্মের নবম আয়োজন নানান কারণে স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে। এবার প্রবাসী বাংলাদেশিদের দীর্ঘ তিন যুগ ধরে অভিবাসন সহায়তা দেওয়ার জন্য মানবাধিকার কর্মী ইয়োশোনারী কাৎসুইকে সম্মাননা দেওয়া হয়। শিল্পী সাদি মোহাম্মদ তিন দিন ধরে শিশু ও তাদের অভিভাবকদের দিয়ে ওয়ার্কশপ করেন। চিত্র অঙ্কনে সেরা আঁকিয়েদের ক্রেস্ট ছাড়াও অনুষ্ঠানের সকল প্রতিযোগীকে পুরস্কৃত করা হয়। পুরস্কারের মধ্যে ছিল বই ও আমাদের জাতীয় পতাকা। শিশু শ্রেণি থেকে যারা প্রথম জুনিয়র স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেছে তাদের বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়।
শিল্পী তুলি গোমেজের গান পরিবেশনা অনুষ্ঠানে ভিন্ন আমেজ দিয়েছে। অনুষ্ঠানটি শেষ হয় জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে। অংশগ্রহণকারী শিল্পী ও হলভর্তি দর্শক যখন জাতীয় সংগীতের সঙ্গে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে গাইতে থাকেন—‘আমার সোনার বাংলা’, তখন সৃষ্টি হয় এক অভূতপূর্ব ব্যঞ্জনা। যেন এক খণ্ড বাংলাদেশ।
সাদি মোহাম্মদ শিশু ও বড়দের নিয়ে বেশ কটি সমবেত সংগীত, প্রিয় ছাত্রী শাম্মী বাবলীর সঙ্গে দ্বৈত সংগীত, জুয়েল আহসান কামরুলের আবৃতির সঙ্গে গান ও তার মোহময়ী কণ্ঠের একক পরিবেশনায় মুগ্ধ করেন।
শিশু মনন উপযোগী চমৎকার মঞ্চটি করেন চিত্রকলার শিক্ষার্থী সালমান। উপস্থাপনায় ছিলেন রেখা রহমান, বিশ্বজিৎ দত্ত বাপ্পা ও সংগীতা রাজবংশী দাশ। সংগীত সহযোগিতায় ছিলেন জাপানের উত্তরণ ও স্বরলিপির সদস্যরা। মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় ছিলেন ফজলুল হক রতন গোলাম মাসুম জিকো।
জাপানে বেড়ে ওঠা শিশু–কিশোরদের বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেখে শিশু কিশোরদের জীবনে মননে দেশ, মাটি ও মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সুরধারা সঞ্চারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশি পরিচালিত একমাত্র শিশু সংগঠন প্রবাস প্রজন্ম ২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করে। সেই থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর এই সংগঠন বার্ষিক আয়োজনের মাধ্যমে শিশু কিশোরদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘প্রবাস প্রজন্ম সম্মাননা দিয়ে আসছে।
অনুষ্ঠানটি জাপানে দুই প্রজন্মের মিলনমেলা হিসেবে খ্যাত। জাপানে প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নেতা ও সংস্কৃতিমনা সহৃদয় ব্যক্তিরা এই সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সহযোগিতায় থাকেন জাপানে বাংলাদেশ কমিউনিটি। বাংলাদেশ দূতাবাসও সহযোগিতা করে।
ছবিঃ রাহমান মনি (সাপ্তাহিক)