সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ অশুভ শক্তি পরাভূত করে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে চলছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা এ শুভ শক্তিরই প্রতীক। দেবী দুর্গা সকল দেবদেবীর সমন্বিতা পরমাশক্তি। অসুন দলনে খিবি চন্ডী, শরনা গতদের কাছে তিনিই আবার সাক্ষা। লক্ষ্মী স্বরূপিনী, মঙ্গরদায়িনী জগন্ময়ী একমাতা। দুর্গাপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এ পূজা শুধু বাঙালি হিন্দুদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের গন্ডি পেরিয়ে দুর্গোৎসব আজ বাঙালি জাতীয় এক অনন্য উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ উৎসবকে ঘিরে সকলের মধ্যে গড়ে উঠে এক সৌহার্দ্য-প্রীতি ওমৈত্রীর বন্ধন, অতি সম্প্রতি তা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
জাপানেও পালিত হয়েছে এ দুর্গোৎসব। প্রতিবছরই এই আয়োজনের পিছনে প্রবাসী বাংলাদেশী কমউনিটি কাজ করে থাকে। এজন্য গঠিত হয়েছে সার্বজনীন পূজা কমিটি জাপান। বাংলাদেশী হিন্দু সমাজই এর মূল উদ্যোক্তা।
সার্বজনীন পূজা কমিটি জাপান’র এবারের আয়োজনটি ছিলো ২২ তম। এই ২২তম আয়োজন উপলক্ষে টোকিওর কিতা সিটি আকাবানে কিতা কুমিন সেন্টারকে সজ্জিত করা হয়েছিল অস্থায়ী পূজা মন্ডপে। ঢাক, ঢোল, কাঁসি, শঙ্খ, সানাই এর বাজনায় সকাল থেকেই উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে, দূর থেকেও তা শোনা যায়।
১ অক্টোবর ২০১৭ রোববার অস্থায়ী এই মন্ডপে প্রবাসী বাংলাদেশী মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব সম্প্রদায়ের লোক পূজায় অংশ নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন।
বেলা ১১ টায় শঙ্খধ্বনির সাথে উলুধ্বনি দিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও দুপুর ১ টায় অঞ্জলি দেওয়ার পর প্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে তা পরিপূর্ণতা পায়। মোট তিনবার সমবেতভাবে অঞ্জলি দেওয়া হলেও অনেকে আবার দেরী করে আসার কারণে পারিবারিক ও ব্যক্তিগথভাবেও অঞ্জলি প্রদান করেন। ভোগ পর্বও সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। অপরাহ্নসাড়ে তিনটা থেকে শুরু হয় পূজা বিষয়ক ধর্মীয় আলোচনা পর্ব। এ পর্বে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলরে (শ্রম) মো: জাকির হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে দূতাবাসের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমার প্রেরিত লিখিত বক্তব্য পাঠ করে শোনান। লিখিত বেক্তব্যে রাষ্ট্রদূত আয়োজকদের ধন্যবাদসহ সকলকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানান।
তনুশ্রী গোলদার বিশ্বাসের উপস্থাপনায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সার্বজনীন পূজা কমিটি জাপান এর সভাপতি শ্রী সুনীল চন্দ্র রায়, সহসভাপতি তাপস সাহা এবং সাধারণ সম্পাদক শ্রী রতন বর্মন।
পূজা বিষয়ক ধর্মীয় আলোচনা করেন সার্বজনীন পূজা কমিটি জাপান এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শ্রী সুখেন ব্রহ্ম। ধর্মীয় ব্যাখ্যায় শ্রী সুখেন ব্রহ্ম বলেন, সনাতন ধর্মের আদি অবলম্বন হচ্ছে ‘ঋগ্বেদ’। ঋগ্বেদ অনুসারে ভগবানের উপর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস। আমরা বিশ্বাস করি ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। যাকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। তিনি বলেন, ধর্ম হচ্ছে শাশ্বত নীতি। ন্যায়নীতি ও সার্বিক সদাচারের সমাহার, হিন্দু ধর্ম ভারতীয় উপমহাদেশের নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, মন ও মাটি থেকে স্তব: উৎসারিত। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ-এ এর বিশদ বর্ণনা আমরা পাই।
গীতাও বেদান্তমুখী হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। গীতা জীবন ও জগৎমুখী, এর নিষ্কাম কর্মযোগের তত্ত্ব আধুনিক হিন্দু ধর্মের ভক্তিবাদের উৎস। গীতার আগে উপনিষদ বা বেদান্ত। যার মূলকথা হচ্ছে সর্বেশ্বরবাদ। বেদের সঙ্গে বেদান্তের সম্পর্ক আত্মার। শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন অন্তরের চৈতন্যকে। রামকৃষ্ণ বলেছেন, যতো মত ততো পথ’র কথা, আর স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, উপলব্ধি’র কথা। তাঁদের সম্মিলিত উচ্চারণে ধর্মের মূলকথা হচ্ছে, ‘‘বিভেদ নয়- মিলন, মর্মভেদ থাকতে পারে জাতিভেদ নয়।’’ অর্থ্যাৎ বৈচিত্রই মানব ধর্ম।
জাপানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করে সার্বজনীন পূজা কমিটি জাপান’র উপদেষ্টা ড. কিশোর কান্তি বিশ্বাস বলেন, প্রতিবছর আমরা পূজার আয়োজন করতে গিয়ে বিভিন্ন বিড়ম্বনার শিকার হই। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হল পাওয়া। আমরা যদি একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। হলের ভেতর তিন-চারশো লোকের স্থান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমরা একসাথে সবাই বসতেও পারি না। আপনারা যদি অনুদানের পরিমাণটা আরেকটু সচেতনতার সাথে করতেন তাহলে জাপানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা তেমন কঠিন কিছু নয়। আমরা ইতোমধ্যে কয়েকটি স্থান দেখেছি। দরকার কেবল অর্থের।
আলোচনা পর্ব শেষ হলে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্টানও ভক্তিমূলক গানের আসর। ববিতা পোদ্দারের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথমেই ছোটদের পর্ব। ছোট ছোট চেলেমেয়েরা শারদীয় সাজে শ্বেত শুভ্র পোশাকে বিভিন্ন শ্লোক, মন্ত্রপাঠ, আবৃত্তি, নাচ, গান, ছড়া এবং অভিনয় করে অতিথি দর্শকদের মাতিয়ে রাখে।
এরপর প্রবাসী অ্যামেচার শিল্পীরা ঙ্গিীত পরিবেশন করেন। দূতাবাস কর্মকর্তার পত্নীও সৌখিন শিল্পীদের সাথে সঙ্গীতে অংশ নেয়।
বরাবরের মতো এবারও স্থানীয় প্রবাসী সাংস্কৃতিক সংগঠন উত্তরণ পূজা উপলক্ষে ভক্তিমূলক গান এবং কীর্তন পরিবেশন করেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হলে শুরু হয় আরতী। আরতীতে ঢাকের শব্দে ধুনচি ধুনট হাতে নৃত্যের তালে তালে বৌদিয়া এবং প্রজন্ম একসাথে নেচে গেয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে।
সিঁদুর খেলায় নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের রঙিন করা হয়। এরপর মিষ্টিমুখ ও আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে বিষাদের ছায়ায় দেবী দুর্গাকে প্রতীকী বিদায় জানানো হয়।
উল্লেখ্য বাংলাদেশে দুর্গা পূজা ৫ দিন ধরে হলেও বিভিন্ন কারণে জাপানে একদিনে সমস্ত আচার পালন করার মাধ্যমে নিকটবর্তী রোববার দিন পালিত হয়ে থাকে।
সৈজন্যে রহমান মনি ( সাপ্তাহিক, জাপান প্রতিনিধি )