Breaking News

বিশ্বভ্রমণে!

রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’ বইটিতে দেখিয়েছেন টাকা-পয়সা ছাড়াই কীভাবে বিশ্বভ্রমণ করা যায়। তার দেখানো পথেই ইচ্ছে হলে বিশ্ব ঘুরে দেখা খুবই সম্ভব। সেটা আদ্যিকাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বড় একটি সত্য। এখন তথ্যের অবাধ সরবরাহ ও কানেক্টিভিটির কারণে ভ্রমণ অনেক সহজ। তারপরও অর্থ অনেকের সামনে বড় বাধা বলে মনে হয়। কিন্তু অর্থের বাধা উপেক্ষা করে এ জমানাতেও প্রায় বিনাখরচে বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক ভ্রমণবিলাসী। সেরকম তিন ব্যক্তিকে নিয়েই এই ফিচার।

লরা বিংহাম : সাইকেলে ৭০০০ কিমি পাড়ি

আর্জেন্টিনায় ঘুরতে গিয়েছিলেন লরা। সঙ্গে ছিল তার বোন। দুদিন বাদে রাস্তায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে যেচে পরিচিত হন তারা দুজন। লরা ভদ্রলোককে জানান, গত বছর সাইকেলে পুরো স্পেন ঘুরেছিলেন তারা। এ কথা শুনে ভদ্রলোক দু’বোনকে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানান। তার মা একেবারে জড়িয়ে ধরে অভ্যর্থনা জানান এবং সে রাতে এত খাওয়ান যে নিজেদের রাজকন্যার মতো মনে হচ্ছিল। পরদিন অপর একজন সাইক্লিস্ট তাদের আমন্ত্রণ জানায় এবং দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে। তার পরের দিন অন্য এক বন্ধুর বাসায় আহার-বিহারের ব্যবস্থা হয়। পথে এক ব্যাগ কমলা দেয় স্থানীয় এক ব্যক্তি। সেও তার বাসায় থাকার আমন্ত্রণ জানায়। বিভিন্ন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে দ্রুত পরিচিত হয়ে যাওয়া এবং বিভিন্ন মানুষের ভালোবাসা তাদের ভাবিয়ে তোলে। এ রকম ঘটনা তাদের এ পথে নামতে উৎসাহিত করে।

সময় যখন প্রতিকূলে: পুরো দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণের সময় অনেক সুন্দর ঘটনার মুখোমুখি যেমন হয়েছেন তেমনি চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে। লরার জন্য সবচেয়ে কঠিন সময়টি আসে ভ্রমণের ষোলতম দিনে। চারদিন ধরে আন্দিজের উজানে সাইকেল চালাচ্ছিলেন লরা। বাইরে ছিল প্রচুর বৃষ্টি আর পেটে তীব্র ক্ষুধা। একের পর এক ঘরে গিয়ে আহার চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু সব ঘর থেকেই নেতিবাচক জবাব আসে। কেউ কোনো প্রকার সাহায্য করতে রাজি হচ্ছিল না। অবশেষে এক বাড়িতে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন লরা। গৃহকর্ত্রীর কাছে একটু সাহায্য চাইলেন। গৃহকর্ত্রী তার মুখের দিকে তাকালেন, অবস্থার ভয়াবহতা উপলব্ধি করেও তিনি তার হাত নেড়ে ‘না’ জবাবিই দিলেন। না, তিনি কোনো সাহায্য করতে পারবেন না। শরীরের সমস্ত শক্তি ও মনের সব দৃঢ়তাকে পুঁজি করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন লরা।

লরার পরামর্শ: সাইকেলে করে একই ধরনের ভ্রমণে যেতে চাইলে লরার পরামর্শ হচ্ছে- সঙ্গে মালসামানা পারতপক্ষে কম নেওয়া। বেশি বোঝা ভ্রমণকে কঠিন করে দেয়। সঙ্গে কিছু অনুপ্রেরণামূলক ভিডিও ও গান। ব্যাস! নেমে পড়ুন বিশ্বভ্রমণে! চেখে দেখুন পৃথিবীর সুন্দর ও কঠিন দিকগুলো!

রব গ্রিনফিল্ড : ব্রাজিল থেকে পানামার পথে টাকাবিহীন ৭২ দিন

ব্রাজিলে যখন বিমান থেকে নামেন তখন রব গ্রিনফিল্ডের পকেটে ছিল না কোনো টাকা, কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ, কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা- বলা যায়, কিছুই ছিল না। সামনে অপেক্ষা করছিল সাত হাজার মাইলের রহস্যময় ভ্রমণ। তবে তার লম্বা ভ্রমণটা তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। আমরা জীবনে অনেক জিনিসপত্র চাই, অনেক অর্থ চাই এবং মনে করি এগুলো ছাড়া জীবন অসম্ভব। কিন্তু রব গ্রিনফিল্ডের সাত হাজার মাইল ভ্রমণ বা টাকাহীন টানা ৭২টি দিনের অভিজ্ঞতা সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে।
যখন কঠিন সময়ের মুখোমুখি: খাবারাদাবার সংগ্রহ, পানীয় ও ঘুমের ব্যবস্থা করা ছিল সেই ৭২টি দিনের প্রতিদিনকার চ্যালেঞ্জ। একবার পেরুর মহাসড়কে ভুল করে নেমে পড়েন এবং কোথায় যাবেন ঠিক করতে পারছিলেন না। শুধু ১৩০ কিলোমিটার যাওয়ার জন্যই তাকে ১২ বার গাড়ি পাল্টাতে হয়েছিল। তবে সেসব কঠিন চ্যালেঞ্জ ও কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া জীবনের বিভিন্ন রূপকে সামনে নিয়ে আসে।

ভ্রমণপিপাসুদের উদ্দেশ্যে গ্রিনফিল্ড: এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে আত্মনিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। এছাড়া নিজের অত্যন্ত জরুরি জিনিসগুলো ম্যানেজ করার জন্য নিজেকেই এগিয়ে যেতে হবে। ঘুমানোর জন্য সঙ্গে একটি তাঁবু, পানি বিশুদ্ধ করার যন্ত্র, রান্নাবান্নার ছোট চুলা আর গরম পোশাক অবশ্যই রাখতে হবে সঙ্গে। বিভিন্ন জায়গায় থাকার ব্যবস্থা বা কাজের বিনিময়ে খাবার সংগ্রহ করার জন্য কয়েকটি ওয়েবসাইটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। এমন কয়েকটি ওয়েবসাইট হচ্ছে- wwoof.org, helps.net, এবং workaway.info.

রিনাল পাটেল : যুক্তরাজ্যের নিজ বাড়ি থেকে হংকং

রিনাল পাটেলের কাছে হিচ হাইকিংয়ের সেরা দিক হচ্ছে একেবারে অপরিচিত মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। ইন্দোনেশিয়ার বান্দা আচেহ প্রদেশে কোনো গাড়ি পাচ্ছিলেন না। মহাসড়কে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লেও কারো দিল সাড়া দিচ্ছিল না। রিনাল ও তার বন্ধু প্যাকোর এই দুরবস্থা দেখে এক ইন্দোনেশীয় বয়স্ক নারী রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যান। সেই বয়স্ক নারীকে দেখে একটি দ্রুতগ্রামী গাড়ি থামতে বাধ্য হয়। আজকের জমানার অনেক শিশু ও তরুণের থেকে সেই বয়স্ক নারী অনেক সাহসের পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে করেন রিনাল পাটেল। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষমতাও অসাধারণ ছিল রিনালের জন্য। বিভিন্ন এলাকার মানুষ যেচে এসে তাদের সাহায্য করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার আপডেট ফলো করে অনেকেই বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা করেছে।

টয়লেটেও কাটাতে হয়েছে রাত

রিনালের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল জার্মানিতে। সেখানে এক রাত টয়লেটে ঘুমাতে হয়েছিল। বার্লিন থেকে এক ভদ্রলোক তার ব্লগ পড়ে মেসেজ পাঠিয়েছিল তাকে কীভাবে সাহায্য পাঠাতে পারে। যখন রিপ্লাই দিতে যাবেন তখন দেখে ওয়াই-ফাই সংযোগ বিচ্ছিন্ন যায়। তার পরবর্তী ৯০ মিনিট বিভিন্ন জনের কাছে মোবাইল ধার চান একটি ফোন দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রত্যেকেই মুখের ওপর না বলে দেয়। শেষে একটি মেয়ে রাজি হয়; কিন্তু সে তার বয়ফ্রেন্ডের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে বলে। টয়লেট থেকে ফিরে সেই বয়ফ্রেন্ড জানায়-‘দুঃখিত, আমরা কোনো হেল্প করতে পারছি না! কে জানে আপনি হয়তো কোথাও বোমা হামলার পরিকল্পনা করছেন।’

রিনালের উপদেশ: এটা একটা কঠিন জার্নি আর মেয়েদের জন্য আরও কঠিন। সাধারণত রাতের বেলা অপরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলতেন না রিনাল। স্থানীয় লোকদের সাহায্য চাইতে হবে, মানুষের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা কয়েকটি ভাষা জেনে রাখতে হবে আর কোনো দেশে প্রবেশ করার আগে সেটা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য জেনে রাখলে বেশ কাজে লাগে। উপরের তিনজনই কোনো টাকা ছাড়াই বিশ্বভ্রমণে নেমেছেন। অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেমন তাদের যেতে হয়েছে তেমনি অসাধারণ অভিজ্ঞতাও জমেছে তাদের জীবনঝুলিতে। সব মিলিয়ে জীবনের ভাণ্ডারে অনেক বড় সব স্মৃতি জমা হয়েছে বলেই মনে করেন তারা। যাদের মনে বিশ্বভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে; কিন্তু টাকার জন্য ভয় পাচ্ছেন, উপরের আলোচিত তিন ভ্রমণপাগল মানুষের কাছ থেকে দীক্ষা নিতে পারেন তারা। তীব্র মনোবল, ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে আপনিও হয়তো অর্জন করে ফেলতে পারবেন অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা।

লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য গার্ডিয়ান-এর উইল কোল্ডওয়েল-এর ইন্টারভিউ অনুসরণে লিখেছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

About admin

Check Also

কিউশুতে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় দুর্যোগের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে

 জাপানের কিউশুতে বুধবার প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত আবারও আঘাত হানছে। অব্যাহত বৃষ্টিপাত ভূমির উপরিভাগ আলগা করে দেয়ায় …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *