মঞ্চ নাটক ‘ক্রাচের কর্নেল’ মঞ্চায়িত। গত বৃহ:স্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৭ বেইলী রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে, সন্ধ্যা ৭ টায় বটতলা’র নবম প্রযোজনা হিসেবে ‘ক্রাচের কর্নেল’ এর ১৭তম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
মঞ্চ নাটক ‘ক্রাচের কর্নেল এর মঞ্চকথা
ক্রাচের কর্নেল—স্বাধীনতা যুদ্ধে পা হারানো এক কর্নেলের জীবনের গল্প। কর্নেলের জীবনের আগাগোড়া বিধৃত ও বর্ণিত এক নাটক ক্রাচের কর্নেল। কর্নেল আবু তাহের। এই কর্নেলের নাম ও সাতই নভেম্বর ১৯৭৫-এর সিপাহি বিপ্লবে তাঁর ভূমিকার এক অস্পষ্ট ও রহস্যময় গল্প সবারই জানা। তবে সিপাহি বিপ্লবের প্রকৃত রূপটা কী? কেন সিপাহি বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল? আমাদের অনেকের কাছেই তা স্পষ্ট নয়। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক শাহাদুজ্জামান তাঁর ক্রাচেরকর্নেলনামক প্রামাণ্য উপন্যাসে সেই ধূসর বৈপ্লবিক ঘটনাপ্রবাহকে ঐতিহাসিক উপাচারে মূর্ত করেছেন।
তাঁর নিজের ভাষ্যে জানা যায় যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কালপর্বকে উপজীব্য করে লিখেছেন এই উপন্যাস। যেখানে তিনি নিজে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্রান্তিকালটিকে বুঝবার চেষ্টা করেছেন কর্নেল তাহের নামের এক অমীমাংসিত, বিতর্কিত ও বর্ণাঢ্য চরিত্রের মাধ্যমে। সুতরাং ক্রাচের কর্নেল এমন এক সময়ের উপন্যাস, যে সময়ের ধারাবাহিকতায় আমরা এখনো চলছি।
বটতলার সর্বশেষ প্রযোজনা ক্রাচেরকর্নেলনাটক নিয়ে লিখতে বসে শাহাদুজ্জামানের উপন্যাসের প্রসঙ্গ টেনেছি এ কারণে যে এই নাটকটি তাঁর রচিত ক্রাচের কর্নেল উপন্যাসের নাট্যরূপ। সৌম্য সরকার ও সামিনা লুৎফা নিত্রা এই উপন্যাসের নাট্যরূপ দিতে গিয়ে যেমন ঘনিষ্ঠ থেকেছেন উপন্যাসের সঙ্গে, তেমনি জুড়েছেন উপন্যাসের নাটক হয়ে ওঠার উপাদান। ফলে নতুন এক মাত্রা তৈরি হয়েছে মঞ্চ পরিবেশনায়। শাহাদুজ্জামান তাঁর প্রসঙ্গকথায় বলেছেন, ‘ক্রাচেরকর্নেলযখন লিখেছি, তখন এর মঞ্চ সম্ভাবনার কথা ভাবিনি। এই প্রামাণ্য উপন্যাসে যে ব্যাপক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও অগণিত চরিত্র জটিল, সর্পিল রাজনৈতিক ঘটনাবলির বয়ান আছে, তাকে মঞ্চের ভাষায় তুলে আনা এক দুরূহ কাজ বলে মনে হয়েছে।’ তাঁর এই ধারণা সঠিক, তবে আমার বিবেচনায় বটতলা এই দুরূহ কাজটাকে অতি সযতনে অতি দক্ষতার সঙ্গে অতি সহজেই সাধন করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিরাভরণ নাটকের পক্ষপাতী। নাটকের সাজসজ্জা, আলো, পোশাক—এসবের আড়ম্বরের চেয়ে প্রকৃত অর্থে ঘটনার ঘনঘটা আমি সমর্থন করি বেশি। বটতলা অতি সুচারুরূপে এক আড়ম্বরময় ঘটনাপ্রবাহকে অনাড়ম্বর আয়োজনে পরিবেশন করেছে। একটা নাটকের দলেক্রাচেরকর্নেল নাটকটির মহড়া চলছে এবং ক্রমে তা ঘটনার গভীরে প্রবেশ করছে, এ রকমই একটা আবহ তৈরি করে আবু তাহেরের সমগ্র জীবন তুলে ধরেছে তারা দর্শকদের সামনে। তাহেরের মা আশরাফুন্নেসার সাংসারিক একনিষ্ঠতা ও সন্তানদের প্রতি তাঁর বাৎসল্য ও মমত্ব, বাবা মহিউদ্দিন আহমেদের স্টেশনে স্টেশনে বদলি হওয়া রেলওয়ের চাকরি, ১০ ভাইবোনের সংসারের শৃঙ্খলাবোধ—এসবের মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে মূর্ত হয়ে কর্নেল তাহের আমাদের সামনে এক ক্ষণজন্মা পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। একসময়ের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর যুবক একই স্বপ্ন নিয়ে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। অতঃপর মুক্তিযুদ্ধের ডাক। দুঃসাহসিক এক অভিযানের ভেতর দিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও এক সম্মুখসমরে নিজের পা হারিয়ে ক্রাচনির্ভর জীবনযাপন ও জেল যাপন, অতঃপর এক ভয়ানক রাজনৈতিক প্রহসনের বিচারে ফাঁসির মঞ্চে জীবনদান—এই হলেন কর্নেল তাহের। এই গল্পই শাহাদুজ্জামানের গবেষণালব্ধ প্রামাণ্য উপন্যাস থেকে আহরণ করে মঞ্চে এনেছে বটতলা, যা এক ভীষণ পরিকল্পনামাফিক তৈরি নাট্যকর্মের ফসল। মোহাম্মদ আলী হায়দার একজন পরীক্ষিত নির্দেশক। ক্রাচেরকর্নেল নির্মাণে হায়দার আরও বেশি কুশলী ও মেধাবী ভূমিকা রেখেছেন। ঘটনার ঠাসবুননে গাঁথা একটা নাটককে তিনি অনায়াসদর্শন করে তুলেছেন। দর্শক বুঝতেই পারে না কখন কীভাবে দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। একটা দল তাদের একটি নাটকের মহড়া করছে, নাটকটা হয়তো এক সেপাইয়ের জীবননির্ভর কিন্তু মহড়ায় হাজির ছেলেমেয়েরা প্রাত্যহিক পোশাকটাই পরবেন। সে বিচারে পোশাককে আমি প্রশ্নবিদ্ধ করব না। যেখানে যেটুকু প্রয়োজন, যে আবহ সৃষ্টির প্রয়োজন, অত্যন্ত সফলভাবেই আলো তা করেছে, অভিনয়ও অত্যন্ত চরিত্র ঘনিষ্ঠ হয়েছে। একই অভিনয়শিল্পী একেক সময়ে হয়ে উঠেছেন একেক চরিত্র। এক কর্নেল তাহেরের চরিত্রেই অভিনয় করেছেন প্রায় চারজন অভিনয়শিল্পী। তাই নাম ধরে কার অভিনয় ভালো লেগেছে, এটা বলবার প্রয়োজন নেই। কেবল মার্চপাস্ট করিয়ে ক্যান্টনমেন্টের আবহ তৈরি ও সময় অতিক্রম বোঝানোটাও আমার ভালো লেগেছে। আমি যেদিন নাটকটা দেখি, সেদিন উপস্থিত ছিলেন ড. কামাল হোসেন ও আ স ম আবদুর রব, যাঁরা ঘটনার চরিত্রও বটে। মঞ্চে ঘটমান গল্পের অনেক চরিত্র আপনার পাশে বসে নাটক দেখছেন, তা এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এই অনুভূতি হয়তো আপনিও পেতে পারেন ক্রাচেরকর্নেলদেখতে গিয়ে। দেখে ফেলুন বটতলার ক্রাচের কর্নেল।
“ক্রাচের কর্নেল” বাংলাদেশের ইতিহাসকে বহুমাত্রিক চশমা দিয়ে দেখার নাটক। বাংলাদেশকে নির্মাণ করতে যে সকল মহৎ প্রাণ মানুষ ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদেরকে ঐতিহাসিক ভাবে অবহেলা করার দলিল।
অনেক ধন্যবাদ দিতে চাই বটতলা নাট্যদলকে। তারা মঞ্চে যা করে দেখাল সেটি একটি সাহসী ঘটনা। তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ এবং তাদের কুশীলবদের তুলে আনা, বিশেষ করে কর্নেল তাহের এবং তার অবদানকে ফুটিয়ে তোলা, ইতিহাসের অন্ধকার আচ্ছন্নতাকে আঙ্গুলি নির্দেশ করা- আমাদের জন্য অনেক বিরাট পাওয়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানীতে ব্যাপক আকারে ইহুদী নিধন হয়েছে হিটলারের হাতে। লেখিকা হ্যানা আরেন্ট তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন কিভাবে ইহুদীরা নিজেরাও হিটলারের অত্যাচার থেকে বাঁচতে চুপ করে ছিলেন। গ্যাস চ্যাম্বারের মুখে নিজেরা সারি বেঁধে মৃত্যকে আলিঙ্গন করেছেন। এবং তাঁর লেখা পরে অনেক সমালোচিত হয়েছে ইহুদীদের কাছেই। কিন্তু তবুও লেখিকা হত্যাযজ্ঞের দাঁয় ভার কিছুটা হলেও ইহুদীদের দিয়েছেন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে অনেক সময় মানুষ নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনে। তখন বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হবার পর বাংলাদেশের পুরো রাজনৈতিক কাঠামোতে যে পরিবর্তন এলো সেই সময়ের ব্যক্তিরা আজ ধরা ছোঁয়ার বাহিরে। ইতিহাসে তারা আজ যে আসন দখল করে আছে তার পুরো ভিন্ন চিত্র হতে পারত। অথচ আমাদের নিজেদের উদাসীনতা, নেতৃত্বে ব্যর্থতার জন্য আরোপিত এক ইতিহাস নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে।
নাটক নিয়ে ফিরে আসি। মঞ্চ নাটকের এমনই মোহনীয় গুণ যে তা মানুষকে পুরো সময় জুড়ে আকৃষ্ট করে রাখে। “কোর্ট মার্শাল”-এর পর “ক্রাচের কর্নেল” হচ্ছে সেই উচ্চ মাপের চিন্তক নাটক। যে নাটক আপনাকে ইতিহাসের ধাপের সাথে পরিচিত করিয়ে দিবে। হাসাবে যতটা তার চেয়ে বেশি আক্রমণ করবে। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিবে আপনার জানা ইতিহাসে কত শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। জয় হোক মঞ্চ নাটকের।’
১৯ অক্টোবর, ২০১৭
তথ্যসূত্র: “ক্রাচের কর্নেল” নাটকের নাট্যকার ও নির্দেশক এবং নিয়ামত আলী এনায়েত এর লেখা থেকে।