মানবজীবনে বড় পরিচয় তার নিজস্ব সংস্কৃতি। এই নিজস্ব সংস্কৃতি মানুষের রসনা, ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিকতা, পোষাক, ললিতকলা সবকিছুতেই নিজস্ব পরিচয় বহন করে। মূল ছাড়া যেমন গাছ দাঁড়াতে পারে না তেমনি নিজস্ব সংস্কৃতি ছাড়াও প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। জাপানে বেড়ে ওঠা প্রবাসী শিশু কিশোরদের জীবনে মননে বাংলাভাষা, বাংলা সংস্কৃতির পরিচয় এবং ধারন করার লক্ষেই প্রবাস প্রজন্মের আয়োজন। সেই অর্থে বলা যায় বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষামূলক একটি আয়োজন।
২০০৭ সালে জাপানে বাংলাদেশীদের দ্বারা পরিচালিত একমাত্র শিশু সংগঠন ‘‘প্রবাস প্রজন্ম’’ যাত্রা শুরু করে। সেই থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর প্রবাস প্রজন্ম জাপান বার্ষিক আয়োজনের মাধ্যমে শিশু কিশোরদের উৎসাহ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিদের আমন্ত্রন জানিয়ে ‘‘প্রবাস প্রজন্ম সম্মাননা’’ দিয়ে আসছে। ৯ম প্রবাস প্রজন্ম জাপান সম্মাননা ২০১৮ পেয়েছেন বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, জীবন্ত কিংবদন্তী সাদী মহম্মদ। বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে তিন যুগেরও বেশী সময় হবে অবদান রাখার জন্য সাদী মহম্মদকে এই সম্মাননা দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও একই সংগে জাপান প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য অবদান রাখায় এশিয়ান পিপলস সোসাইটি (এপিএফএস) প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান উপদেষ্টা ইয়োশিনারি কাতসুও কে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয়। জাপান প্রবাসীদের পরম এই বন্ধু দীর্ঘ তিন দশক ধরে প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করে আসছেন।
প্রবাস প্রজন্ম আয়োজনে একটি যাত্রা যোগ হয় বাংলাদেশ থেকে আগত সম্মানিত অতিথি, শিক্ষক, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদী মহম্মদ কর্তৃক আয়োজিত তিনদিনের ওর্য়াকশপ। শিশু, কিশোর, অভিভাববৃন্দের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো ওয়ার্কশপটি তিনদিনের ওয়ার্কশপে স্বনামধন্য শিল্পীর সান্নিধ্যে গান গাইতে পারার আনন্দ লাভে উচ্ছস্বিত হয় সবাই।
৬ মে ২০১৮ রবিবার টোকিওর সুদৃশ্য তাকিনোগাওয়া কাইকান হলে প্রবাস প্রজন্ম জাপান আয়োজিত মনোজ্ঞ সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয়।
বিকেল ৩:৩০ মিনিট থেকে সকল অংশগ্রহণকারী শিশু, কিশোর, অভিভাবকবৃন্দ হলে এসে উপস্থিত হন। এ সময় প্রবাস প্রজন্মের উদ্যোগে শিশু কিশোরদের জমা দেওয়া হাতে আঁকা ছবিগুলো হলের গ্যালারীতে প্রদর্শিত হয়। এর মধ্য থেকে নির্বাচিত প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরষ্কার ঘোষনা মূল অনুষ্ঠান শেষে দেয়া হয়, উল্লেখ যে, বাংলাদেশ থেকেও এবার অনেক শিশু কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতায় অংশ নেয় ই,এম,এস,এর মাধ্যমে।
এবারের প্রবাস প্রজন্ম অনুষ্ঠানটি দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। অনুষ্ঠানটিতে জাপান সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ এবং জাপান বাংলাদেশের সংস্কৃতিমনা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
বিপুল সংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা এশিয়ান পিপলস সোসাইটি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বর্তমান উপদেষ্টা ইয়োশিনারি কাতসু এবং বাংলাদেশ থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদী মহম্মদকে সম্মাননা ক্রেষ্ট তুলে দেন।
স্বান্ধ্যকালীন জাকজমকপূর্ণ এই আয়োজনে জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আশরাফ উদ দৌলার সভাপতিত্বে আয়োজকদের পক্ষ থেকে স্বাগতিক ও শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন প্রবাস প্রজন্ম জাপান এর সদস্য সচিব রাহমান মনি। অভিভাবকদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ড. তপন কুমার পাল। এছাড়াও সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন এপি, এফ, এস, এর বর্তমান সভাপতি ইয়োশিদা মায়োমি, বিশেষ অতিথি জাপান ফরেন প্রেস সেন্টার এর সভাপতি আকাসাকা কিয়োতাকা, বিশেষ অতিথি, জাপান নিউ কোসেইতো পার্টির প্রাক্তন সভাপতি, বর্তমান নীতিনির্ধারক, জাপান সরকারের ভূমি অবকাঠামো, পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের সাবেক মন্ত্রী ওতা আকিহিরো।
প্রবাস প্রজন্ম আয়োজনে টোকিও এবং আশে পাশের প্রদেশগুলো থেকে অর্ধশতাধিক শিশু কিশোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তাদের মেধার বিকাশ ঘটায়। নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, পিয়ানো, ভায়োলিন দিয়ে শিশুকিশোরদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছিলো।
শুরুতেই প্রবাস প্রজন্ম সংবাদ পরিবেশন করে হোসনে আরা তানজু। এরপর স্বরলিপি কালচারাল একাডেমির শিশুদের ‘‘চল্ চল্ চল্’’ গানের সংগে প্যারেড হয়। এরপর দলীয়ভাবে ‘‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’’ গানটির পর দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে। কথাশ্রী বিশ্বাস ও ভাগ্যশ্রী পাল দ্বৈত নৃত্য পরিবেশন করে। আবৃতিতে অংশ নেয় যথাক্রমে তাশদিদ সুদিপ্ত আলভি, জেসিয়া বিনতে জালাল, সাদিয়া তাবাসুম, নাঈম নাওকি, ফারিয়া তাইয়েবা। একক নৃত্যে অংশ নেয় নাশরাহ আহমেদ, রেইনা হোসেন, নিশাত হায়দার লামিয়া, নাপিজা সোরা শারমিন, মেহজাবিন আদিবা, মিনি জাপান খ্যাত আজরিন কারিমা নাবা। অনুষ্ঠানে একক গানে অংশ নেয়-তুলি গোমেজ, দ্বিপ্ত হুদা, তনুতা ঘোষ, অবন্তি দাশ, সুহিনা বড়ুয়া, অহনা বড়ুয়া, আংকা বনিক, ওয়াফিক মুহাইমিন, রাশিফ করিম, ফারিয়াল রামিহা। তাশদিদ আলি পিয়ানো এবং সাদনান সাফিন ভায়োলিন সুর তুলে শুনায়। রণজিৎ হারমোনিয়াম আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরি গানটির সুর বাজায়।
শিশু কিশোরদের অংশগ্রহণের সাংস্কৃতিক পর্ব শেষ হলে বাংলাদেশ থেকে আগত অতিথি শিল্পী সাদী মহম্মদ মঞ্চে উঠলে বাংলাদেশ কমিউনিটির বিভিন্ন সুধীজন ফুল দিয়ে শিল্পীকে সম্মান জানান। এ সময় বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সাদী মহম্মদের ছাত্রী জাপানের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী শাম্মী আক্তার বাবলি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক শাল পরিয়ে দেন। এরপর শুরু হয় কাংখিত সংগীত পর্ব। জনপ্রিয় শিল্পী গান শুরু করলে হলভর্তি দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন। কণ্ঠশিল্পী শাম্মী বাবলি তার স্যারের সংগে ডুয়েট গান করে দর্শক শ্রোতাদের মন জয় করে নেন। অনুষ্ঠানটির যান্ত্রিক সহযোগীতায় ছিলেন স্বরলিপি ও উত্তরণ কালচারলি এর সম্মানিত সদস্যবৃন্দ।
অনুষ্ঠানটির এক পর্যায় ওয়ার্কশপে অংশ নেয়া ছোটদের ২টি, বড়দের ৩টি, এবং সমবেতভাবে ২টি মোট ৭টি গান পরিবেশিত হয়। মাত্র তিনদিন শিখিয়ে মূল আয়োজনে পরিবেশন রীতিমতো বিস্ময়ের হলেও সাদি মহম্মদের পক্ষেই যে কেবল সম্ভব তা জাপান প্রবাসীরা অবলোকন করেছেন।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে অতিথি শিল্পীর নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এসময় জাপানী অতিথিরাও দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। কেউ কেউ ঠোঁট মিলিয়ে গাইতে চেষ্টা করেন।
সাংস্কৃতিক পার্টি শেষ হলে শিশু কিশোরদরে চিত্রকলা প্রদর্শনীর পুরষ্কার ঘোষনা করা হয়। ২টি বিভাগে এই পুরষ্কার দেওয়া হয়। ‘‘ক’’ বিভাগে প্রথম হবার গৌরব অর্জন করে সুবহা রুজেন করিম। আর ‘‘খ’’ বিভাগ থেকে প্রথম হবার গৌরব অর্জন করে ফারিয়াল রামিহা। দুটি ১ম, ২য়, ৩য় ও বিশেষ পুরষ্কার ছাড়াও অংশগ্রহণকারী সবাইকে প্রবাস প্রজন্ম উপহার দেওয়া হয়। উপহারের মধ্যে ছিলো বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, বর্ণমালার বই এবং গল্পের বই। এছাড়াও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া সকল শিশু কিশোরদের একটি করে মেডেল দেয়া হয়। অনুষ্ঠানটি জাপানে ‘‘দুই প্রজন্মের মিলন মেলা’’ হিসেবে খ্যাত। জাপানে প্রবাসী বাংলাদেশী ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, সাংস্কৃতিমনা সুহৃদয় ব্যক্তিবর্গ এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সহযোগীতায় থাকেন জাপান বাংলাদেশ কমিউনিটি, বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রি ইন জাপান এবং বাংলাদেশ দূতাবাস।
সর্বোপরি সবার সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগীতায় প্রতিবছরের ন্যায় এই বছরও প্রবাস প্রজন্ম অনুষ্ঠানটি সফলতার সংগে সুসম্পন্ন হয়। বিদেশের মাটিতে দেশীয় সংস্কৃতির একটি সুন্দর আয়োজন
সন্তষ্টচিত্তে সবাই উপভোগ করেন।
ছবিঃ রাহমান মনি (সাপ্তাহিক)