শিনজো আবের বাংলাদেশ সফরের দিন দশেক আগে আমার বাসার পোস্ট বক্সে দুইটি চিঠি পাই। একটি আমার স্ত্রীর নামে এবং একটি আমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ের নামে। চিঠি দুইটি সম্পূর্ণ জাপানী ভাষায় মুদ্রিত। আমি জাপানী ভাষা তেমন একটা পড়তে পারিনা তবে যতটুকু ধারনা করলাম তা থেকে বুঝলাম যে এটা কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাগজ। এরপর একদিন সময় করে আমার এলাকার ওয়ার্ড অফিসে গেলাম। কাগজ দুটি একজন ভদ্র মহিলাকে দেখালাম, সাথে সাথেই উনি আমাকে আরেকটা রুমে নিয়ে গেল সেখানে আরও কয়েকজন মহিলা সারিবদ্ধ হয়ে টেবিল চেয়ার নিয়ে যেন আমাদের জন্যই বসে আছে। জাপানিজ সৌজন্যতা পর্ব সেরে কাগজ দুটি দেখে আমাকে বলল “আপনার স্ত্রী আর সন্তান কে সরকার দশ হাজার করে বিশ হাজার ইয়েন দিবেন”। আমি খুশি হবনা ব্যাথিত হবো বোঝার আগেই জিজ্ঞেস করলাম কেন? ভদ্র মহিলা বলল জাপানের নতুন কর আইন অনুযায়ী সবাই যে হটাৎ করে ৮% করে ভোগ কর দিচ্ছ এইজন্য জাপান সরকার বিশেষ প্ররদনা হিসাবে এই দশ হাজার ইয়েন করে সব গৃহিণী এবং বাচ্চাদেরকে দিচ্ছে। হটাৎ করে বিশ হাজার ইয়েন পেয়ে ভালোই লাগছিল পক্ষান্তরে এই ভেবে খারাপ লাগলো যে এই দেশের প্রধান মন্ত্রী যাবে আমাদের দেশের নেতাদের সাথে দেখা করতে। কতোই না ব্যবধান এই দুই দেশের নেতাদের মধ্যে। চিন্তাভাবনা, আচার আচারন, কথাবার্তা, জাতীয়তা বোধ এই গুলোর কিছুই কি আমাদের নেতাদের মধ্যে আছে। ভাবছিলাম শিনজো আবে যখন বাংলাদেশের নেতাদের সাথে হাত মেলাবেন এমন যদি হতো তখন শিনজো আবের হাতের মধ্যে থেকে তার গুণাবলি সমূহ আমাদের নেতাদের মধ্যে পরিবৃত্তি হয়ে যেত। না বেশী হয়ে যাচ্ছে। আবেগ সামলে নিলাম। কিন্তু বিষয়টা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিষয়টা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করি। বেশকিছু ভালো তথ্য পেলাম যা নিহনবাংলাডটকম এর পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছা করল। একটু পেছন থেকেই শুরু করি। নব্বই দশকের শুরুর দিকে অধিক ফুলেফেঁপে উঠা জাপানের সম্পদ মূল্য নির্ভর অর্থনীতি (Japanese asset price bubble) সহজ ভাষায় জাপানের “বাবল ইকোনমি” যার আভিধানিক অর্থ হয় এরকম “বুদবুদ অর্থনীতি” তা ভেঙ্গে পড়ে ভীষণ ভাবে। ভেঙ্গে পড়ার তিব্রতা ব্যপকভাবে চিন্তিত করে তোলে জাপানের অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, সরকার সহ দেশের মানুষদের। সেই দশকে অর্থাৎ ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সাল কে জাপানিরা “হারিয়ে যাওয়া দশক” বা “Lost Decade” বলে আখ্যায়িত করে। হারিয়ে যাওয়া দশকে সম্পদ মূল্য হারানোর সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবে জাপান তার মোট দেশজ উৎপাদনও অর্থাৎ জিডিপি (GDP) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ক্রমান্বয়ে ব্যার্থ হতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৯০ এর দশকে এসে প্রথমবারের মত জাপান অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত স্থবির একটি পর্যায়ে প্রবেশ করে, সে সময় প্রবৃদ্ধির হার ছিল বছরে গড়ে মাত্র ১%। ২০০০ সালের পর থেকে এর কিছুটা উন্নতি হওয়া শুরু হতে থাকে। ১৯৯৪ সালে জাপানে মোট বেকার ছিল ১৯,২০,০০০ জন যা ১৯৯৯ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩১,৭০,০০০ জনে। ২০০৭ সালে প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২%-এর কিছু বেশি ছিল। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটু পেছনে দেখি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানকে সাবাই জানতো পৃথিবীর অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে। জাপানকে সংগ্রাম করে গড়ে উঠতে দেখেছে সবাই। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দ্বীপের মানুষ গুলো কতোইনা পরিশ্রম করে জাপানকে নতুন ভাবে গড়েছে তা আমাদের সকলের জানা। জাপানের বৃদ্ধদের কাছে সে সময়ের কথা জানতে চাইলে এখনো বর্ণনা দিতে গিয়ে তাদের চোখ জ্বল চলে আসে। ভাবুনতো একবার যে দেশের গড় প্রবৃদ্ধি ১৯৬০ সালে ১০%, ১৯৭০ এ ৫% এমনকি ১৯৮০ সালেও ছিল ৪% এবং অনেক অর্থনীতিবিদ ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ সাল এই সময়কে “যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক অলৌকিক ঘটনা” বা “Japanese post-war economic miracle” হিসেবে উল্লেখ্য করেন, আর সেই প্রবিদ্ধির হার যদি নেমে আসে ১% এ তাহলে কেমন মাথা নষ্টের কারবার হয় ! আমারিকার মতো বড় বড় মোড়ল দেশগুলোও তালগোল পাকিয়ে ফেলত নিশ্চয় ! বলে রাখি ১৯৪৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড় প্রবিদ্ধির হার কখনই ৩.২৭% নিচে নামেনি। তার উপর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা যেন মরারা উপর খাড়ার ঘা জাপানের জন্য। একাধিকবার ভোগ কর আরোপ এর হার বৃদ্ধি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে অনেকটা। বর্তমানে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে জাপানের জনগণকে ৮% কর দিতে হচ্ছে এবং ২০১৫ সাল এ তা বেড়ে ১০% হবে। এর জন্য রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে অনেকবার। কাউকে আবার নির্বাচনে হারতে হয়েছে। জাপানে যারা বসবাস করছেন এবং ভোগ কর বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত তাদেরকে জানিয়ে রাখি যুক্তরাষ্ট্রে ভোগ কর ১১.৭২৫%, বাংলাদেশে ১৫%, যুক্তরাজ্যে ২০%, ইটালিতে ২২%, সুইডেনে ২৫%, হাঙ্গেরিতে ২৭% ইত্যাদি। এই হিসেবে জাপানের জনগণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য এখনও সুবিধাজনক পর্যায়ে রয়েছে আমি মনে করি। আসুন জাপানের ভোগ কর আরোপ নিয়ে আরও একটু সম্পূরক আলোচনা করি। ১৯৭৯ সালে লিবারাল ডেমোক্রেটিক পার্টির মাসাইওশি ওহিরা প্রথম জাপানে ভোগ কর আরোপ করার প্রস্তাব করেন। ১৯৭৪ সালে আমারিকার উইলিয়াম আন্দ্রেওস এর ভোগ কর প্রস্তাবের উপর ধারনা করে মাসাইওশি ওহিরার মনে এই ভোগ কর আরোপের চিন্তা এসেছিলো বলে প্রচলিত কথা আছে বাজারে। যাইহোক নিজের দলেই মধ্যে থেকেই ব্যাপক নেতিবাচক সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে শেষ পর্যন্ত ভোগ কর আরোপের হাল ছেড়েদেন মাসাইওশি ওহিরা। মাসাইওশি ওহিরার ভোগ কর আরোপের প্রচেষ্টার দশ বছর পর একই পার্টির নেতা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নবুরো তাকেশিতা ১৯৮৯ সালে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবাসা ও শ্রমিক সংগঠন গুলোর সাথে দফায় দফায় সভা ও আলোচনা করে ৩% ভোগ কর আরোপের সিধান্ত কার্যকর করেন। জাপানের সাধারণ জনগণ তা মোটেও সহজভাবে মেনে নেননি বলে তৎকালীন সংবাদ পত্র গুলো নেড়েচেড়ে বোঝা যায়। আট বছর পর ১৯৯৭ সালে রীতারও হাশিমোতো এর সরকার ভোগ কর ৩% থেকে বাড়িয়ে ৫% করে। এরপরপরই জাপান ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হয়। শ্রম মজুরি উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়। একদিকে বেতন কমে যাওয়া অন্যদিকে করের বোঝা। বন্ধ হতে থাকে অনেক ব্যবাসা প্রতিষ্ঠান। সেসময় বিপুল সংখ্যক অবৈধ অভিবাসীদেরকে ধরে নিজ দেশে ফেরেত পাঠায় জাপান সরকার। কারন অবৈধ অভিবাসীরা আয় কর পরিশোধ করতনা এবং অবৈধ পথে বা হুন্ডির মাধ্যমে জাপানিজ ইয়েন বিদেশে পাঠাত যা জাপানের অর্থনীতির জন্য সেসময় খুবই ক্ষতিকর দিক ছিল বলে জানা যায়। এছাড়া সেসময় সমগ্র এশিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টিও জাপানের অর্থনৈতিক মন্দার অন্যতম কারন হিসেবে বিবেচিত হয়। ২০০৯ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ জাপান ভোগ বা ভোক্তার কর না বৃদ্ধি করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। সে সরকারের প্রথম প্রধান মন্ত্রী ইউকিও হাতইয়ামা মাত্র সাড়ে আট মাস ক্ষমতায় থাকার পর প্রধান মন্ত্রী পদ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। তার জায়গায় আসেন প্রধান মন্ত্রী নাওত কান এবং উনি এসেই ভোগ কর বৃদ্ধির ঘোষণা দেন কিন্তু নাওত কানও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ডায়েট সদস্যদের চাপ ও অনাস্থায় উনিও পদত্যাগ করেন ২৬ আগস্ট ২০১১তে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ২০০৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নাওত কানই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি এক বছরের বেশি সময় পার করেছেন ক্ষমতায় থেকে। এই ছয় বছরে ছয়বার প্রধান মন্ত্রী বদল হয়েছে জাপানে। এ থেকে আমরা কি বুঝতে পারি ? খুবই সহজ ! এই ছয় বছরে জাপানের রাজনীতি এবংঅর্থনীতি দুইটিই ছিল ভীষণ অস্থির। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবাস্থাকে সুসংগঠিত ভাবে পরিচালনা করতে না পারলে কোন প্রধান মন্ত্রী বা রাজনৈতিক দল টিকে থাকেনি বেশিদিন জাপানে। আমাদের দেশে অবশ্য ঠিক এর উল্টোটা ঘটে। নাইবা গেলাম সে আলাপে। জাপানের অর্থনীতির আলোচনাতেই থাকি। দেখি আরও আকর্ষণপূর্ণ কোন বিষয় পাওয়া যায় কিনা? যাইহোক এসকল ঘটনাক্রমের মধ্যে ২০১১ সালের ভূমিকম্প ও সুনামি, ফুকোশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিস্ফোরণ সহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলাতেও জাপানের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে নিঃসন্দেহ। জাপান অর্থনীতির এমন মন্দা অবস্থায় ২০১২ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে দ্বিতীয় বারের মতো প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হন শিনজো আবে। মনে হচ্ছে আকর্ষণপূর্ণ আলোচনায় বিষয়ে পৌঁছে গিয়েছি। হ্যাঁ আর তাহলো শিনজো আবের আবেনমিক্স (Abenomics) তত্ত্ব। এমন তত্ত্ব বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গেছে বিশ্ব বরেণ্য রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। যেমন ভারতের গান্ধীজির গান্ধিনোমিক্স (Gandhinomics), যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এর রিগানোমিক্স (Reaganomics), বিল ক্লিনটনের ক্লিনটনোমিক্স (Clintonomics) অথবা নিউজিল্যান্ড এর সাবেক অর্থমন্ত্রী রজার ডগ্লাস এর রজেরনোমিক্স (Rogernomics) ইত্যাদি। আবেনমিক্সমূলত “তিন তীর” বা “Three Arrows” নিয়ে পরিকল্পিত শিনজো আবের। আবের তিন তীর হচ্ছে ১। রাজস্ব উদ্দীপক (fiscal stimulus) ২। আর্থিক প্ররদনা (monetary easing) ৩। কাঠামোগত সংস্কারের (structural reforms)। আবের এই পরিকল্পনা নিয়ে গবেষণা করতে যেয়ে আমি খুবই তৃপ্ত বোধকরি এবং আবের প্রতি একধরনের আস্থা ও ইতিবাচক মূল্যবোধ তৈরি হয় আমার মধ্যে। ২০০৮-২০০৯ বছরে রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতির দেশ জাপানের রপ্তানি যখন কমতে শুরু করে এবং তা একধাক্কায় ২৭% কমে যায় (৭৪৬.৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার থেকে ৫৪৫.৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার এ নেমে আসে), জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ০.৭% থেকে ৫.২% কমে গিয়েছিলো ঠিক তখন আবে তার তিন তীরের দুইটি ব্যবহার করলেন ক্ষমতায় আসার এক সপ্তাহের মধ্যে। আবে অতিদ্রুত ১০.৩ ট্রিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন সমপরিমাণ বিল ক্রয়ের ঘোষণা দেন এবং সাথে সাথেই ব্যাংক অফ জাপানের গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দেন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এর সাবেক প্রেসিডেন্ট হারুহিকো কুরোদাকে। এবং কুরোদাকে আবে গুরুত্বের সাথে দায়িত্ব দেন কমপক্ষে ২% মুদ্রাস্ফ্রিতি ঘটানোর জন্য যাতে করে ইউএস ডলার এর পরিবর্তে জাপানিজ ইয়েন এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ঘটে। আবেনমিক্স এই দুই তীর বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাপানের বিভিন্ন আর্থিক বাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়। ২০১৩ ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যেই জাপানিজ ইয়েন নাটকীয় ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং টোকিও স্টক মূল্য সূচক ২২% বৃদ্ধি পায় যা জাপানী অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খুবই জরুরী ছিল। একই সময়ে আর্থিক বাজারে স্থিতিশীলতা বিরাজ করায় ব্যক্তি মালিকানাধীন বিনিয়োগ বেড়ে যায় যার ফলশ্রুতিতে বেকারত্বের হার ৪.০% থেকে ২০১২ শেষে ৩.৭% এ নেমে আসে এবং এখন ৩.৭%। এভাবেই আবেনমিক্স জাপান অর্থনীতিকে দুই দশকের ক্যান্সার থেকে বাঁচিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২০১৫ সালের শেষের দিকে জাপান তার অর্থনীতিকে আগেরমতো শক্তিশালী করতে পারবে বলে আমি মনে করছি। আর শিনজো আবের দূরদর্শিতার প্রশংসা পাবার যোগ্য নিঃসন্দেহে।
গোলাম মাসুম জিকো
সম্পাদক নিহনবাংলাডটকম