শাহ মামুনুর রহমান তুহিন।
সমস্ত বাঙালির খাদ্য রসনায় অন্যতম প্রিয় উপাদান ইলিশ মাছ। আর সেটি বাংলাদেশের হলে তো বলাই বাহুল্য। এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী, অনন্য স্বাদের এবং পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ খাবারও। পানি দূষণ ও নাব্য সংকটসহ নানা কারণে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। সেই সঙ্গে এ মাছের ওপর সরাসরি জীবিকা নির্বাহ করা প্রায় ৫ লাখ মানুষের আয়ের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।
মে মাসে আইএমইডির নিয়োগ দেয়া দোবে ইন্টারন্যাশনাল (প্রাইভেট) লিমিটেড প্রকল্পটি প্রভাব মূল্যায়ন কার্যক্রম সমাপ্ত করে। বর্তমানে প্রতিবেদনটি চূড়ান্তকরণের কাজ করছে সংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইলিশ সমৃদ্ধ পদ্মা, মেঘনা ও অন্যান্য নদী তীরবর্তী শহর ও কলকারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য সরাসরি নদীর পানিতে মিশ্রিত হচ্ছে। ফলে পানির গুণাগুণ ক্রমান্বয়ে মাছসহ জলজ জীবের জন্য বাসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ইলিশ এক সময় হয়তো বাংলাদেশের জলসীমানায় প্রজনন বন্ধ করে দিয়ে অন্য কোথাও এ ক্ষেত্র বেছে নিতে পারে। ফলস্বরূপ এদেশ থেকে চির দিনের জন্য ইলিশ মাছ হারিয়ে যেতে পারে।
‘জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প সংস্থান ও গবেষণা (কম্পোনেন্ট এ ও বি)’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন করতে গিয়ে এ ঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমডি) এক প্রতিবেদনে এ শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে দোবে ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক সবুর দুবে মিডিয়াকে বলেছিলেন, আমরা চেষ্টা করেছি ইলিশ রক্ষাসংক্রান্ত প্রকল্পটির খুঁটিনাটির সবদিক তুলে ধরার। তবে প্রকল্পের বাইরেও অনেক বিষয় ছিল যেগুলো আমরা তুলে আনতে পারিনি। কবে নাগাদ ইলিশ হারিয়ে যেতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি কারিগরি বিষয়। এ নিয়ে বিস্তারিত কাজ করার সুযোগ হয়নি। তবে দূষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত আলাদাভাবে গবেষণা পরিচালনা করা উচিত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের অধীনে মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চলের পানি, মাটি এবং ইলিশ মাছের মাংসে ভারি ধাতু যথা লেড, জিংক, মারকারি এবং লৌহ উপাদানের উপস্থিতি এটোমিক এবজরপসন স্পেকট্রোফটোমেট্রিক পদ্ধতিতে নির্ণয় করা হয়েছে। এসব উপাদানের উপস্থিতি মাটির তলানিতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এবং ইলিশ মাছের মাংসে ও পানিতে পর্যায়ক্রমিকভাবে কম পাওয়া গেছে। ভক্ষণযোগ্য ইলিশ মাছের মাংসে লেড, জিংক এবং ক্যাডনিনয়ামের উপস্থিতি নদ-নদীর ওপরের অংশ থেকে নিম্নাংশে ক্রমাগতভাবে কম পাওয়া গেছে।
ইলিশ মাছের মাংস, পানি ও মাটির তলানিতে এ তিনটি উপাদানের উপস্থিতি নির্ণয় মাত্রার চেয়ে কম পাওয়া গেছে। মেঘনা নদীর ওপরের অংশের পানি দূষণের কারণে এ অংশে ভারি ধাতুর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে নিম্নাংশের চেয়ে বেশি বলে ধারণা করা যায়। এছাড়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা নদীর ওপরের অংশে পানি দূষণ মাত্রা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ফলে জোয়ারভাটা কিংবা বন্যার সময় এসব নদীর দূষিত পানি মেঘনা নদীর নিুাংশ পর্যন্ত পরিবাহিত হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মনুষ্য সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক উভয় কারণে নদীতে পলি জমে ভরাট হওয়ায় মাছের বিচরণ ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এছাড়া ইলিশের প্রজননকালে নদীতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু তোলা অব্যাহত থাকায় ইলিশের ডিম ও রেণু পোনার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। আরও বলা হয়েছে, ইলিশ গভীর জলের মাছ। নদীর গভীরতা ২৫-৩০ ফুটের নিচে নেমে গেলে এদেশের নদ-নদীগুলোয় ইলিশের বিচরণ বন্ধ হয়ে যেতে পারে এর প্রাপ্যতাও কমে যেতে পারে।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদফতর অনেক বড় আকারে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। সেটি এখনও আটকে আছে অনুমোদন প্রক্রিয়ার মধ্যে। এছাড়া দূষণের মাত্রা এবং এ দূষণ রোধের বিষয়ে ইতিমধ্যেই গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে মৎস্য অধিদফতরের সুপারিশের ভিত্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্যাপিটেল ড্রেজিংসংক্রান্ত প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মৎস্য অধিদফতর চতুর্থ মৎস্য প্রকল্পের অধীন ইলিশ ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্লান তৈরি করে বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নিজস্ব তহবিলের অর্থে ২০০৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ‘জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প সংস্থান ও গবেষণা (কম্পোনেন্ট এ ও বি)’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়।
এর মধ্যে কম্পোনেন্ট এ অংশ বাস্তবায়ন করে মৎস্য ও প্রাণী অধিদফতর। এ অংশের ব্যয় ধরা হয় ২২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কিন্তু পরে নানা কারণে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এটি বাস্তবায়নে সময় লাগে ৭ বছর। অর্থাৎ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সমাপ্ত হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ৪০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। প্রকল্পের কম্পোনেন্ট বি (গবেষণা) অংশ বাস্তবায়নে ব্যয় হয় ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল জাটকা ও ডিমওয়ালা ইলিশ সংরক্ষণ করে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো, এর অভয়াশ্রম কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়ন ও জোরদারকরণে সহায়তা, অভয়াশ্রম এলাকায় নির্ধারিত সময়ে জাটকা আহরণ কমিয়ে আনা, জাটকা বা ইলিশ জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং জাটকা সংরক্ষণে অধিক মাত্রায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ৯৬ হাজার মেট্রিক টন বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রকল্প চলাকালীন ৫টি অভয়াশ্রম এবং বর্তমানে একটি স্থাপনের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ফলে ইলিশ ছাড়াও অন্যান্য মাছ যেমন চিংড়ির উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু তারপরও কারেন্ট জাল তৈরি ও বিপণন অব্যাহত থাকায় জাটকা সংরক্ষণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া জাটকা জেলেরা স্বার্থের লোভে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে জাটকা সংরক্ষণে সহযোগিতা করছেন না। জেলেদের জীবিকায়নে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকলে জাটকা সংরক্ষণ ফলপ্রসূ হবে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।