শাহ মামুনুর রহমান তুহিন:
সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছে। ১০০ বছরের ঐতিহাসিক পরিকল্পনাটি তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম। তিনিই মুলত: এনইসি সভায় এ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও এনইসি চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে এটিকে অনুমোদন দিয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, দেশের নদী গুলিতে পলি জমে প্রাণ হারাচ্ছে নদ-নদী। আবার নদীভাঙনে বাস্তুহারা হচ্ছে মানুষ। বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি। জলবায়ু রূপান্তরে বাড়ছে তাপমাত্রা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও দুর্যোগের ঝুঁকি। নগরায়ণের সাথে সাথে বাড়ছে সুপেয় পানির স্বল্পতা, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা। মানুষের প্রাণ-সম্পদ ও পরিবেশ-প্রতিবেশের এসব ঝুঁকি মোকাবেলায় নেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান – ২১০০ বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০।
বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান – ২১০০ বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক দলিল। সামনের দিনে দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তিগত, কারিগরি ও আর্থসামাজিক দলিল হিসেবে এ পরিকল্পনা বিবেচিত হবে। নেদারল্যান্ডসের ব-দ্বীপ পরিকল্পনার আলোকে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনাটি প্রণীত হয়েছে। পরিকল্পনায় অর্থায়ন ও লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন সময় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২০২০-৩০ সালের মধ্যে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এ অর্থ ব্যয় হবে মোট ৮০টি প্রকল্পে। বাস্তবায়নের সম্ভাব্য বাধা চিহ্নিত করে করণীয় বিবেচনায় রোডম্যাপ তৈরি করা হবে। এর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ১০ শতাংশে উন্নীত হবে।
জানা গেছে, পরিকল্পনা প্রণয়নে দেশের আটটি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলকে ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির মাত্রায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একই ধরনের দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোকে অভিন্ন গ্রুপ বা হটস্পটে আনা হয়েছে। এভাবে দেশে মোট ছয়টি হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওড় ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী ও মোহনা অঞ্চল, নগর অঞ্চল ও ক্রসকাটিং বা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অঞ্চল।
এসব হটস্পটের পানিসম্পদ, ভূমি, কৃষি, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, খাদ্যনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ভূ-প্রতিবেশ, নদীর অভ্যন্তরীণ ব্যবহার, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা, পলি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে পানির চাহিদা নিরূপণ ও সুপেয় পানি সরবরাহে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২৭ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটারের উপকূলীয় অঞ্চলের ২৩টি প্রকল্পে ৮৮ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। ২২ হাজার ৮৪৮ বর্গকিলোমিটার ব্যাপ্তির বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চলের নয়টি প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। হাওড় ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের ১৬ হাজার ৫৭৪ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছয়টি প্রকল্পে ২ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় আটটি প্রকল্পে ৫ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা, ৩৫ হাজার ২০৪ বর্গকিলোমিটার নদী ও মোহনা অঞ্চলের সাতটি প্রকল্পে ৪৮ হাজার ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া নগর অঞ্চলের ১৯ হাজার ৮২৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১২টি প্রকল্পে ৬৭ হাজার ১৫২ কোটি ও ক্রসকাটিং বা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অঞ্চলের ১৫টি প্রকল্পে ৬৮ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ক্রসকাটিং অঞ্চল হিসেবে শেরপুর, নীলফামারী ও গাজীপুর জেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ছয়টি হটস্পট অঞ্চলে সব মিলিয়ে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা ব্যয় হবে। বৈঠক পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ডেল্টা তহবিল গঠন করা হবে। এ তহবিলের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কিত তহবিল, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বকে (পিপিপি) বিবেচনা করা হয়েছে। নদী ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু পরিবর্তন আনা হবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেছিলেন, নদীর তীর সংরক্ষণের নামে কোনো প্রকল্প থাকবে না। সাধারণ নদী ড্রেজিংয়ের পরিবর্তে ক্যাপিটাল ড্রেজিং হবে। সঠিকভাবে পলি ব্যবস্থাপনা করতে পারলে বছরে ১ লাখ কোটি টাকার মাটি বিক্রি করা সম্ভব। পণ্য পরিবহনে নদীকে গুরুত্ব দেয়া হবে। ব্লু ইকোনমি ও নবায়নযোগ্য শক্তিতে গুরুত্বারোপ করা হবে। দেশে হাইড্রোলজি বিশেষজ্ঞের অভাব পূরণে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। পানিসম্পদ নিয়ে ১০০ বছরের ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। এ সমঝোতার আওতায় টেকসই ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু অভিযোজনে সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে কারিগরি সহযোগিতা দেবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি জাতীয় উচ্চ কমিটি থাকবে। পাশাপাশি সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকবে জিইডি। জিইডি সদস্য ড. শামসুল আলম বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদে পানি ও খাদ্যের নিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও টেকসই জলবায়ু নিশ্চিত করতেই ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ নেয়া হয়েছে। ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় হটস্পটগুলোর চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা সমাধানে বেশকিছু কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বন্যার ঝুঁকি কমাতে নদী ও পানিপ্রবাহের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ রাখা। পানিপ্রবাহের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নদ-নদীগুলোকে স্থিতিশীল রাখা, পর্যাপ্ত পরিমাণে ও মানসম্মত স্বাদু পানি সরবরাহ করা, নদ-নদীগুলোর পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখা, নদীতে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও যথাযথ পলি ব্যবস্থাপনা।