বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের কথা ভাবলেই আমাদের মনে পড়ে বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট অথবা রথসচাইল্ড ফ্যামিলি সহ বিংশ শতাব্দীর নব্য ধনীদের কথা। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানি না, চৌদ্দ শতকের মালির মুসলিম শাসক মানসা মুসাকে মনে করা হয় বিশ্বের সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তি। মূল্যস্ফীতি হিসেব করে তার তত্কালীন সম্পত্তিকে বর্তমান মুদ্রায় রূপান্তর করলে সেটার পরিমাণ হবে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে রথসচাইল্ড ফ্যামিলির সম্পত্তির মূল্য ৩৫০ বিলিয়ন ডলার, আর বিল গেটসের সম্পত্তির পরিমাণ মাত্র ৯০ বিলিয়ন ডলার!
মানসা মুসার প্রকৃত নাম প্রথম মুসা কেইতা । মানসা হচ্ছে সে সময়ের মালির রাজাদের উপাধি, যার অর্থ হচ্ছে রাজা বা সম্রাট। মুসা ছিলেন দশম মানসা অর্থাৎ মালি সাম্রাজ্যের দশম সম্রাট। মুসার জন্ম ১২৮০ সালে। ১৩১২ সালে, মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করেন।
সম্রাট মুসার ক্ষমতায় আরোহণ
মিসরীয় ইতিহাসবিদ আল-উমারী এর বর্ণনা নুযায়ী, মুসার পূর্বসূরী দ্বিতীয় আবুবকর কেইতা বিশ্বাস করতেন যে, আটলান্টিক মহাসাগর অসীম নয় এবং এর অপর প্রান্তে পৌঁছা অসম্ভবও নয়। তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের সীমানা অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে দুই শতাধিক নৌকা বোঝাই এক বাহিনী প্রেরণ করেন, যাদের সাথে আরও শতাধিক নৌকা ছিল পানি, খাবার-দাবার এবং স্বর্ণমুদ্রা বোঝাই। ক্যাপ্টেনের প্রতি তার নির্দেশ ছিল, মহাসাগরের শেষ না পাওয়া পর্যন্ত, অথবা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কেউ এই অভিযাত্রা থেকে ফেরত আসতে পারবে না।
দীর্ঘদিন পরেও তারা ফিরে না আসায় সম্রাট আবুবকর নিজেই দুই হাজার নৌকা বোঝাই বিশাল এক বাহিনী নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে অভিযান শুরু করেন। তাদের সাথে আরও এক হাজার নৌকা ছিল পানি এবং আনুসঙ্গিক জিনিসপত্র সহ। যাত্রা শুরুর আগে সম্রাট রীতি অনুযায়ী মুসাকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। কিন্তু দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও তারা ফিরে না আসায় সবাই একমত হয় যে, আবুবকর সহ তার বাহিনীর সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। ফলে ১৩১২ সালে মুসা মালির সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত হন।
মুসার রাজ্য বিস্তার এবং ধন-সম্পত্তির উৎস
মুসা যখন ক্ষমতায় বসেন, তখন মালি সাম্রাজ্য বর্তমান মালি এবং দক্ষিণ মৌরিতানিয়ার অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। তার শাসনামল জুড়ে মুসা আটলান্টিক মহাসাগরের তীর থেকে তিম্বাকতু পর্যন্ত পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় ২,০০০ মাইল পর্যন্ত নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন। মুসা বর্তমান সময়ের মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, বুরকিনা ফাসো, নাইজার, নাইজেরিয়া, চাদ, আইভরি কোস্ট সহ ২৪টি শহর এবং এদের আশেপাশের গ্রামাঞ্চল সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জয় করেন।
মুসার ঐতিহাসিক হজ্বযাত্রা
হজ্বযাত্রায় মুসার সাথে ছিল প্রায় ৬০,০০০ মানুষের এক বিশাল বহর, যাদের মধ্যে প্রায় ১২,০০০ ছিল সৈন্য এবং দাস। দাসদের প্রত্যেকের কাছে ছিল ৪ পাউন্ড করে সোনার বার। এছাড়াও তার সাথে ছিল ৮০টি উট, যাদের প্রত্যেকের পিঠে ৫০ থেকে ৩০০ পাউন্ড করে সোনা ছিল। এই যাত্রায় মুসার সাথে তার স্ত্রী ইনারি কোঁতেও শামিল ছিলেন, যার সেবার জন্য ৫০০ দাসী নিযুক্ত ছিল।
যাত্রাপথে তিনি বিভিন্ন শহরে প্রচুর মসজিদ নির্মাণ করেন। কথিত আছে, তিনি প্রতি শুক্রবারে একটি করে মসজিদ নির্মাণ করতেন। তিনি গরীবদেরকে মুক্তহস্তে দান করেন এবং শহরগুলোর শাসকদেরকেও প্রচুর স্বর্ণ উপহার দেন। এছাড়াও তিনি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বিভিন্ন স্যুভেনিয়ার ক্রয় করেন। তিনি যখন মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়ায় পৌঁছেন, তখন এতো বেশি পরিমাণে অর্থ এবং স্বর্ণ ব্যয় করেন যে, মিসরের স্বর্ণের বাজারে বিশাল মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় এবং অর্থনীতিতে ধ্বস নামে।