জাপানে প্রায় তিন যুগ ধরে প্রবাসী কমিউনিটিকে নিয়মিত বিনোদন দিয়ে আসছেন এবং প্রবাসী বাংলা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বাংলা সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য ইত্যাদি চর্চার সুযোগ করে দিয়ে এসেছেন খন্দকার ফজলুল হক রতন (রতন খন্দকার)। জাপান প্রবাসী কমিউনিটি ১৭ নভেম্বর ২০১৯ তাকে বিশেষ ভাবে সম্মানিত করেছেন এক সংবর্ধনা এবং একক সঙ্গীত সন্ধ্যা আয়োজনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ কমিউনিটি জাপান টোকিও-এর কিতা শহরের অজি হক্তোপিয়ার স্কাই হলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জাপান প্রবাসী প্রায় সকল সংগঠনের নেতা কর্মীরা উপস্থিত থেকে এই গুণী শিল্পীকে সংবর্ধনা জাপান। বাংলাদেশ কমিউনিটির পক্ষ থেকে ছালেহ মোহাম্মদ আরিফ সহ কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ জাপানের প্রবাসী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ অবদানের জন্য একটি সম্মাননা ক্রেস্ট উপহার দেওয়া হয়। সেময় প্রবাসীদের ফুললে শুভেচ্ছায় সিক্ত হন রতন খন্দকার। উত্তরণ বাংলাদেশ কালচারাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রতন খন্দকার অনুস্টানে প্রায় ত্রিশটির অধিক গান গেয়ে উপস্থিত দর্শকদের মন জয় করেন। সংগীতা অনুষ্ঠানে তাকে বিশেষ সহযোগিতা করেন এবং সংগীতে সংগত করেন উত্তরণ বাংলাদেশ কালচারাল গ্রুপ এবং ঝিঁঝিঁ পোকা ব্যন্ডের সদস্যরা। স্বরলিপি কালচারাল একাডেমী টোকিও এর অন্যতম সদস্যা তনুশ্রী গোলদার বিশ্বাসের উপস্থাপনায় মনোমুগ্ধকর এই আয়োজনে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন প্রবাসী কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের প্রবাসীদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ কমিউনিটির এই আয়োজন নিঃসন্দেহে একটি মহতী উদ্যোগ বলে নিহন বাংলা ডট কমকে অনুভূতি জানিয়েছেন জাপান প্রবাসীরা এবং বাংলাদেশ, আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশের প্রবাসী এবং খন্দকার রতনের বন্ধু ও শুভাখাংকি মহল।
আমাদের রতনঃ
নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশে একটি গানের অ্যালবাম বেশ পরিচিতি লাভ করে – আমার শ্রাবণ আমারই থাক খ্যাত বহুল জনপ্রিয় গানটির গায়ক খন্দকার ফজলুল হক রতন, আমাদের রতন ভাই। জাপান প্রবাসী বেশিরভাগ বাংলাদেশিদের কাছে তিনি রতন দা নামে পরিচিত। কিন্তু আমাদের অনেকের কাছে তিনি গুরু নামে স্বীকৃত। আমরা অনেকই তার কাছ থেকে সরাসরি সঙ্গীত শিক্ষা না নিলেও কেন জানি আমরা অনেকই তাকে প্রান ভরে গুরু নামেই সম্বোধন করে থাকি। অনেকের কাছেই প্রশ্ন করেছি, জানতে চেয়েছি আপনি তাকে গুরু বলে ডাকেন কেন? অনেক ধরনের উত্তর পেয়েছি। কেউ বলেছেন আমি গান শিখেছি তার কাছে, কেউ বলেছেন উনি বাংলা সঙ্গীতের অনেক শাখাতে দক্ষ, কেউ বলেছেন দীর্ঘদিন ধরে এখানে সঙ্গীত চর্চা করছেন তাই, কেউ আবার হেসে বলেছেন উনার সাদা চুল দেখে, এমনিই গুরু বলতে মন চাই। কিন্তু কোন উত্তরই আমার মনের মতো হচ্ছিল না যেন। আসলে জাপান প্রবাসীদের জাপানে বাংলা গান, নাটক তথা বাংলা সাংস্কৃতিক চর্চার গোরাপত্তনের গল্পে তার নাম না নিলেই নয়। হয়তোবা এটাই তার গুরু খ্যাতি পাওয়ার অন্যতম কারন। অন্তত আমি সেরকমই বুঝতে পেরেছি তাকে নিয়ে ক্ষুদ্র গবেষণা করতে যেয়ে।
শৈশব এবং শিক্ষা জীবনঃ
১৯৬২ সনের এপ্রিল মাসে কুষ্টিয়ার কোট পাড়া নিবাসী পিতা খন্দকার আক্কেল আলি এবং মাতা ছাবেরা খতুনের ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন রতন খন্দকার। নয় বোন এবং দুই ভাই মোট এগারো জনের মধ্যে পঞ্চম সন্তান তিনি। শৈশব কেটেছে কোট পাড়াতেই। কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ডাকার আইসিএমেতে ভর্তি হন তিনি। আইসিএমে পড়াকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে চান্স পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালীন ১৯৮৪ সালে বাবা মারা যান হটাৎ করে। সংসারের হাল ধরতে কুস্টিয়াতে ফিরে যেতে হয় তাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর পড়াশুনা শেষ করা হলনা আর তার। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে বিএ পাশ করেন তিনি।
সঙ্গীত জীবনঃ
রতনের বড় বোনকে বাসায় গান শেখাতে আসতেন ওস্তাদ গিয়াস উদ্দিন। সাত বছর বয়স থেকে রতন ওস্তাদ গিয়াস উদ্দিনের কাছে গান শেখা শুরু করেন। সেই থেকেই সঙ্গীত জীবনের শুরু হয় তার। ক্লাস নাইন থেকে কুস্টিয়ার নাটকের গ্রুপ বোধন এর সাথে জড়িত হন। পড়া মহল্লার থিয়েটারে, স্কুলে কলেজে অনেক নাটকে অভিনয় করেন তিনি। হিরক রাজার দেশে, গোপী গাইন বাঁধা বাইন ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করে কুস্টিয়াতে পরিচিত হয়ে উঠেন রতন খন্দকার।
প্রবাস জীবনঃ
ঘটনাক্রমে এক বন্ধুর মাধ্যমে ১৯৮৬ সালে জাপান আসেন রতন খন্দকার। ভর্তি হন একটি জাপানিজ মিউজিক স্কুলে। সেখানে পড়াশুনা করার সময় জাপানিজ একটি কম্পানির প্রজেক্টে বাংলাদেশ ফিরে যান তিনি। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রখ্যাত গিতিকার এবং সুরকার মিল্টন খন্দকারের গীত এবং সুরে প্রযোজনা সংস্থা বিউটি কর্নার এর ব্যানের প্রকাশিত হয় সুস্মিতা শিরনামে তার একটি গানের ক্যাসেট। গুরু অবশ্য আমাকে বলেননি সুস্মিতাটা আসলে কে? যাই হোক, সুস্মিতা যেই হোক না কেন সুস্মিতা এ্যালবামটি কিন্তু ব্যপক জনপ্রিয়তা পায় দেশে। বিশেষ করে কাঁটার আঘাত নেবে সুবাস নেবে না ফুল তাই কি হয় / আবার ফাগুন যদি পিছু দেই ডাক গান দুটি বেশ পরিচিত হয়। এ্যালবামটি এখন পরিবেশক কম্পানি আশিক মিউজিক এর ব্যানারে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৯৩ সালে জাপানি নারী এন্দো কিজুরো সাথে ঘর বাঁধেন রতন খন্দকার।
আশির দশকের গোরার দিকে জাপানে বাংলা গান বাজনা চর্চার কোন দল বা সংগঠনতো দুরের কথা কারও বাসায় একটা হারমনিয়াম খুজে পেলে মনে হত যেন আলাদিনের চেরাগ পাওয়া গিয়েছে। এমনি এক সময়ে তৎকালীন বাংলাদেশ দুতাবাসের কর্মকর্তা জনাব মিজারুল কায়েস রতন খন্দকার, মুনশি কে আজাদ, রেনু আজাদ, মান্না, টিপু, রিকি শাহিন সহ কিছু বাংলাদেশিদের দুতাবাসে গান বাজনা চর্চা করার সুযোগ করে দেন। সেখান থেকেই কমিউনিটি বেইজড বাংলা গান-বাজনা চর্চার শুরু। মাঝারুল ইসলাম দুলাল তাদের নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করাতেন। এরপর রতন খন্দকার কিছু বন্ধুদের নিয়ে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন উত্তরণ বাংলাদেশ কালচারাল গ্রুপ, জাপান। সেই থেকেই আজ অব্দি প্রায় ৩১ বছর ধরে জাপানে বাংলা গান এরং বিভিন্ন সাংক্রিতিক বিষয়ের চর্চা করে যাচ্ছেন রতন খন্দকার। রতন দা মুলত লালন, ফোক এবং আধুনিক বাংলা গান করতে পছন্দ করেন। ভুপেন হাজারিকা মান্না দে তার প্রিয় শিল্পী।
ছবি এবং ভিডিও সহযোগিতায়ঃ তানিয়া মিথুন, নাজিম উদ্দিন, পপি ঘোষ।