শীত আসে। সেই সঙ্গে হাজির হয় পিঠা উৎসব। এ সময় টাটকা চালে তৈরি করা হয় বাহারি পিঠা পুলি। পিঠার সেই মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে মূলত ঋতুর প্রথম ভাগ থেকে। আমাদের গ্রামবাংলায় একটি প্রবাদ আছে,‘পরের হাতের পিঠা, গালে লাগে মিঠা।’ এ গেল দেশ-প্রাণের কথা। প্রবাসের মা-বোন ও বধূরাও কিন্তু পিঠা তৈরিতে একটুও পিছিয়ে নেই। পিঠা কে না খেতে চায়। পিঠার নাম শুনলেই জিবে পানি এসে যায়। সে জন্য জাপানে বসবাসরত প্রবাসীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় তৃতীয় আশিকাগা পিঠা উৎসবের। ১০ ফেব্রুয়ারি রোববার তোচিগি কেনের আশিকাগা সিটিতে বাংলাদেশ কমিউনিটি কিতা কানতোর পক্ষ থেকে ও সুইয়ামা লুবনা ও নোমান সৈয়দের উদ্যোগে এ পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
প্রবাসীদের পিঠা খাওয়ার অতৃপ্তি কিছুটা দূর করার পাশাপাশি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরাও ছিল এই আয়োজনের উদ্দেশ্য। জাপানের বিভিন্ন শহরের ৭০টি পরিবারের ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৬০ জন এই পিঠা উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। পিঠা উৎসবটি জাপানের কানতো অঞ্চলের বাঙালির এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। নারীদের সবার পরনে ছিল একই রং ও ডিজাইনের বসন্তের শাড়ি। আর পুরুষদের পরনে ছিল বাঙালির প্রিয় পোশাক পাজামা-পাঞ্জাবি।
মধ্যাহ্নভোজনে ছিল মা-বোন ও বধূদের হাতে তৈরি মজাদার ভর্তার সমাহার। উল্লেখযোগ্য ভর্তার মধ্যে ছিল বেগুন ভর্তা, বরবটি ভর্তা, আলু ভর্তা, ডাল ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা, ধনে পাতার ভর্তা, লইট্টা শুঁটকির ভর্তা, টমেটোর চাটনি, আচারি বেগুন, চাপা শুঁটকির ভর্তা, আলু শুঁটকির ভর্তা, মাছ ভর্তা, ব্রকলি ভর্তা, মিষ্টিকুমড়া ভর্তা, খুরি ভর্তা, চিকেন ভর্তা, শুঁটকি ভুনা ও গরুর মাংসের ভুনা। বাচ্চাদের জন্য ছিল চিকেন ফ্রাই ও টুনা মাছের চপ।
বিভিন্ন পর্ব দিয়ে সাজানো হয় এবারের পিঠা উৎসব। ছোট্ট সোনামণি মিমনুনের কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় পিঠা উৎসবের। প্রথম পর্বে ছিল ছোট সোনামণিদের আরবি সুরা পাঠ, যেমন খুশি তেমন সাজো ও মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এই পর্বটি পরিচালনা করেন গোলাম মোস্তফা ও সুমনা রহমান। এরপর ছোট সোনামণিরা হাজির হয় নাচ, গান ও আবৃত্তি নিয়ে। এই পর্ব শুরু হয় ‘আমি বাংলার গান গাই’ গানের সঙ্গে নাপিজার নেতৃত্বে দলীয় নৃত্য দিয়ে। সোনামণিদের পারফর্মেন্স এর মধ্যে দর্শকদের মন জয় করে আজরিন করিম নাবা, নাপিজা ও তিহানের নাচ, মাইমুনার গান ও রাইনার আবৃত্তি। ফৌজিয়া, আয়ান ও রাইনার চিত্র অংকন সবাই প্রশংসা করে। অংশগ্রহণকারি সবাইকে মেডেল পরিয়ে দিয়ে বই কেনার জন্য গিফট কার্ড হাতে তুলে দেন ফাতেমা বেগম কাজল ও শেলি তাহের।
দ্বিতীয় পর্বে ছিল বড়দের অংশগ্রহণে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দর্শকদের মন জয় করে জাহেদি ভাই, নাঈম ভাই, শাম্মি আপু, মোস্তফা ভাই, সোহাগ ভাই, মিন্টু ভাই, তরিকুল ভাই, আঁখি ভাবি, সাবরিনা ভাবি ও সুমনার একক সংগীত। জাহেদি ভাইয়ের সঙ্গে শাম্মি আপু, আঁখি ভাবি ও সেবু ভাবির দ্বৈতসংগীত সবার মন ছুঁয়ে যায়। আয়েশা মিতু ভাবির আবৃত্তির সময় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে হলের মধ্যে। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন টোকিও বৈশাখী মেলার সমন্বয়কারী মো. আসলাম খন্দকার হিরা, লেখক-সাংবাদিক কাজী ইনসানুল হক ও স্বরলিপি কালচারাল একাডেমির সভাপতি নাসিরুল হাকিম। এ ছাড়া ছিল ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে তিনটি নাটিকা। নাটিকায় অভিনয় করেন চম্পা ও শোভন দম্পতি, বন্যা ও মোস্তফা দম্পতি এবং সুমনা ও সোহাগ দম্পতি। তিন দম্পতির সাবলীল অভিনয় দর্শকের মন জয় করে নেয়। এ পর্ব পরিচালনা করেন গোলাম মোস্তফা ও সুইয়ামা লুবনা।
বরাবরের মতো আশিকাগা পিঠা উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল পিঠা প্রতিযোগিতা। নিজ হাতের তৈরি পিঠা নিয়ে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন ২৫ জন প্রতিযোগী। পিঠা প্রতিযোগিতায় ছিল চারটি বিভাগ। প্রতিটি বিভাগের জন্য ছিল আলাদা আলাদা নম্বর। প্রতিযোগিতার বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন মো. আসলাম খন্দকার হিরা, কাজী ইনসানুল হক, শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী শাম্মি বাবলি ও সংগীতশিল্পী রওনক জাহান। প্রতিযোগিতায় বিচারকদের রায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন খোদেজা আক্তার মুক্তা। তিনি তৈরি করেন ক্ষীর নারকেল পিঠা। কিডস পিঠা তৈরি প্রথম রানারআপ নির্বাচিত হন সালমা ইসলাম। নকশি পিঠা তৈরি দ্বিতীয় রানার আপ নির্বাচিত হন ফাতেমা লুৎফর চম্পা। চতুর্থ ও পঞ্চম নির্বাচিত হন আসমাউল হুসনা লিজা ও সুমনা রহমান। বিশেষ তিনটি পুরস্কার পান আয়েশা সিদ্দিকি মিতু, শাহেলা সুলতানা রেণু ও আদ্রিনা সুমি। বিজয়ীদের মুকুট ও ট্রফি তুলে দেন আসলাম খন্দকার হিরা, কাজী ইনসানুল হক, শাম্মি বাবলি, রওনক জাহান ও নাসিরুল হাকিম। সব সময়ের মতো এবারও চমক দিয়ে চমৎকার কিছু উপহার নিয়ে হাজির হন কাজী ইনসানুল হক। তিনি আয়োজকদের উপহার দেন দ্বিতীয় পিঠা উৎসবের ছবি দিয়ে তৈরি অ্যালবাম। এ উপহার পেয়ে আয়োজকেরা খুশিতে আত্মহারা হন।
এরপর ছিল পিঠা ভোজন। মজাদার প্রায় ৫০ রকমের পিঠা দিয়ে সাজানো হয় পর্বটি। উল্লেখযোগ্য পিঠার মধ্যে ছিল ভাপা, নকশি, বিবিখানা, পাটিসাপটা, মুগপাকন, দুধ চিতই, ফুলঝুড়ি, কিডস, বিস্কুটের ক্ষীর, নারিকেলের পুলি, ক্ষীর রস মঞ্জুরি, নকশি, পোয়া, গোলাপ, রঙিন পাটিসাপটা, কিমা ফুলি, নারিকেলের পাকন ও সুজির রস মঞ্জুরি পিঠা। মিষ্টান্নের মধ্যে ছিল রসগোল্লা, পুডিং ও চকলেট কেক। ঝাল আইটেমের মধ্যে ছিল শিঙারা ও চটপটি। পিঠা উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল অপ্সরার গয়নার বাক্সের সৌজন্যে র্যাফেল ড্র। র্যাফেল ড্র চলার সময় সবার মধ্যে ছিল জেতার চরম উত্তেজনা। র্যাফেল ড্রতে তিনটি আকর্ষণীয় শাড়ি ও গয়নার সেট জিতে নেন ইমু, বন্যা, শামিমা, সাথি ও লিজা। এ আকর্ষণীয় পর্বটি পরিচালনা করেন নোমান সৈয়দ। তাঁকে সহযোগিতা করে পাঁচজন ছোট সোনামণি। অনুষ্ঠানে সবার আগে উপস্থিত হওয়ার জন্য পাঙ্কচুয়াল ফ্যামিলি পুরস্কার পান নাসরিন লতা। সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য অ্যাটেনটিভ ফ্যামিলি পুরস্কার পান সুলতানা ইসলাম। সাউন্ড সিস্টেম ও মিউজিকের দায়িত্ব পালন করেন জাহেদি সোহেল। আয়োজকদের পক্ষ থেকে সাংবাদিক ফখরুল ইসলামকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান নোমান সৈয়দ। এ ছাড়া চমৎকার এই আয়োজনের জন্য সুইয়ামা লুবনা এবং অনুষ্ঠান সফল করতে যাঁরা সার্বিক সহযোগিতা করেছেন তাদের সবাইকে সবার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন শাহাজাহান সাজু।