সাম্প্রতিককালে যুগপরিবর্তন খালি চোখেই পরিলক্ষিত হচ্ছে জাপানে। সংবাদপত্র খুললেই নিত্যনতুন পরিবর্তনের ছবি ও সংবাদ তাক্ লাগিয়ে দিচ্ছে! সেই তুলনায় বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাগুলো কোন্ পর্যায়ে আছে তা ভেবে ক্লান্তিকর ঠেকে। প্রতিদিনই দুর্নীতি, অর্থআত্মসাৎ, জ্বালাওপোড়াও, খুনখারাপি, গুম, ধর্ষণ, হত্যা, রাজনৈতিক বাচলতা, অব্যবস্থা, অবহেলা, দুর্ঘটনা, সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটপাট, নগরায়নের নামে–উন্নয়নের নামে পুকুরচুরি, প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংস, প্রশ্নফাঁস, জেলজুলুমের খবরই প্রধান খবর হয়ে চোখের সামনে লাফায়! মনে হয় আস্ত একটি অচলায়তন নরক গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে! অবশ্যই এতে করে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমকে দোষী করা যায় না কারণ যা ঘটছে তাই পত্রিকাগুলো তুলে ধরছে। কিন্তু সমাজগঠনে, জাতিগঠনে, নগরগঠনে সংবাদপত্রের ভূমিকা রাষ্ট্রের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়! সেই ভূমিকা পালন করছে কি বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো সেই প্রশ্ন করা যেতেই পারে! জাপানের পত্রিকাগুলো প্রতিদিনই দুঃসংবাদ তুলে ধরলেও ভালো সংবাদ থাকে অধিকাংশ যা পাঠ করে উজ্জীবিত হওয়া যায়। তেমনি কতিপয় সংবাদ দৈনিক কুমিল্লার কাগজ পত্রিকার পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি:
পুরনো গাড়ি এখন ই-ভিকল:
ক্লাসিক গাড়িগুলোকে চালানো যাবে ইলেকট্রিক ব্যাটারি দিয়ে। বিষয়টি প্রথমে অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল। সংবাদ পড়ে সন্দেহ পরিষ্কার হলো। যেহেতু ষাট-সত্তর বছর আগের গাড়িগুলোর যন্ত্রাংশ নেই এখন আর কোথাও, তেল ব্যবহারের যন্ত্রপাতিও নেই। সুতরাং এইসব ভিনটেজ কার কীভাবে ব্যবহার করা সম্ভব?
কিন্তু তা সম্ভব হয়েছে। য়োকোহামার একটি কোম্পানি সেই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। চলছেও পুরনো গাড়ি। এবং প্রকৃতিবান্ধব ‘একো কার’ হিসেবে রাস্তায়। আর চলছে বৈদ্যুতিক শক্তির সাহায্যে অর্থাৎ ইলেকট্রিক ব্যাটারির জোরে।
জগতের কিছুই ফেলনা নয়, সেই চিরপ্রবাদ সত্যি হয়েছে। তেল এবং গ্যাসেরও ব্যবহার দিন দিন ফুরিয়ে আসছে। ইভি (ইলেকট্রিক ভিকলস), বায়ুশক্তি, জলশক্তি এবং সৌর প্রযুক্তির যুগ এই একুশ শতক। সব মেশিনপত্র, যানবাহন, বিমান ও যুদ্ধজাহাজও চলবে এই শক্তিগুলোদ্বারা। তেল ও গ্যাস উৎপাদক দেশগুলোতে নাভিশ্বাস উঠলো বলে! এই শক্তিগুলোকে ব্যবহার করে জীবনব্যবস্থা পাল্টে ফেলছে জাপানÑÑএখনো এশিয়ার যথার্থ অর্থেই শিল্পোন্নত একমাত্র দেশ। কত কিছুই না আছে এই দেশটিতে শেখার আশ্চর্য হই কেবলি! বাংলাদেশ সরকারের উচিত শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের এই দেশে পাঠানো প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য।
একটি গ্রন্থের শক্তি:
একটি এ হোন [ওইশিই মানমারুসান] নামক শিশুবিষয়ক পিকচার বুককে কেন্দ্র করে একটি নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মুক্ত হলো, ছুটে এলো সুগন্ধী বাসন্তী হাওয়া টোকিওর পুরনো বইয়ের রাজধানী জিনবোওচোও শহরে ২৫শে ফেব্রুয়ারি। উক্ত গ্রন্থটি লিখেছেন বিশিষ্ট লেদার-ক্রাফট রাইটার এবং শিশুসাহিত্যিক শ্রীমতী গোমি হিরোমি।
তার বইটিকে কেন্দ্র করে জিনবোওচোও শহরে অবস্থিত ‘বুক হাউস কাফে’ প্রতিষ্ঠানে উদ্বোধন করা হলো [কোদোমো বুক্কু ওয়ার-দো, তোকুবেৎসু কিকাকু, কোদোমো মো, ওতোনা মো হোন দে আসোবো!] অর্থাৎ, [শিশুগ্রন্থজগত, বিশেষ কর্মসূচি, শিশু এবং বয়স্কদের বই নিয়ে খেলা] নামে একটি প্রাণবন্ত উৎসব। জাপানে শিশুজন্মের হার ক্রমাগত হ্রসমান তারপরও শিশুদের স্বর্গরাজ্য হচ্ছে এই দেশটি প্রাচীনকাল থেকেই। শিশুদের জন্য এ্যাত বই আর কোনো দেশে প্রকাশিত হয়েছে বা হয় বলে আমার জানা নেই! ২৫ বছরের বেশি জাপানের মুদ্রণ ও প্রকাশনা জগতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এত সমৃদ্ধ শিশুগ্রন্থ এবং অনুবাদ আর কোনো দেশে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। জাপানিরা স্বভাবগত গ্রন্থপ্রিয়।
সে যাই হোক, এই উৎসবে শূন্য বয়স থেকে ৭ বছরের শিশুদের নিয়ে ৬০ জন উপস্থিত হয়েছিলেন সেদিন। একটি দিন তারা কাটালেন বিচিত্র সব গ্রন্থের সঙ্গে তার মধ্যে মানগা (কার্টুন) এবং পিকচার বুকই বেশি। শিশু এবং বই এই দুটির মতো অজাতশত্রু আর কিছু নেই পৃথিবীতে। আধুনিক জাপান তা প্রমাণ করে চলেছে। রাষ্ট্র ও সমাজ এই গ্রন্থমেলা, গ্রন্থপাঠ আন্দোলনের মাধ্যমে সুশ্রী, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ হতে বাধ্য। বাংলাদেশে এই আন্দোলনটার স্বপ্নই আমি দেখে আসছি অনেক বছর ধরে। শিশুরা যথার্থরূপে মানুষ হলেই জাতি উন্নত না হয়ে পারে না।
‘চালকহীন’ বাহনের যুগ:
যেসকল দেশ একবার প্রযুক্তির শীর্ষস্থান দখল করেছে তার অগ্রসরচিন্তা ও উদ্ভাবনকে আটকে রাখা অসম্ভবÑÑতার প্রমাণ জাপান। তাই দেখা যায় প্রায় প্রতি বছরই একজন না একজন জাপানি বিজ্ঞানী বা গবেষক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন। তাঁদের গবেষণাকর্ম নীরবেই ঘটছে জানতেই পারি না। যদিও জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, শ্রমিকের অভাবে কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আয় কমে যাচ্ছেÑÑকিন্তু তাই বলে কি বসে বসে হুঁকো টানতে হবে! জাপান সে দেশ নয়! দেড়শ বছরের প্রাচীন উচ্চমানসম্পন্ন বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ প্রাচ্যের এই দ্বীপবর্তী দেশটি ক্রমাগত বদলাচ্ছে।
সেই বদলের চিত্রই দৃশ্যমান হতে চলেছে অচিরেই শহরে শহরে ‘মুজিন উনতেনশিকি’ জনপরিবহন ব্যবস্থা বা পরিষেবা। বিস্ময়কর সংবাদই বটে! কিন্তু সেটাই বাস্তবে পরিণত করতে সদাব্যস্ত জাপানিরা। রাস্তায় নেমে গেছে ‘চালকহীন’ নগর বাস! অবশ্য অনেক বছর আগেই টোকিও বে এরিয়ায় অবস্থিত বিশাল ‘বিগ সাইট’ নামে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী কেন্দ্র পর্যন্ত যাত্রীবহনে চলাচল করছে নাতিদীর্ঘ চালকহীন মোনোরেল ‘রিনকাইছেন’ শিনবাশি স্টেশন থেকে। সুতরাং সেদিন মোটেই দূরে নেই যেদিন প্রাইভেট কারগুলোও রাস্তায় চলাফেরা করবে অবাধে চালক ছাড়াই কম্পিউটার প্রযুক্তির বদৌলতে। অতিসম্প্রতি ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে ইলেকট্রিক পাওয়ারে চলাচলকারী ‘কনেক্টেড কার’ বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে মানুষের। নিপ্পন টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ তথা এনটিটি দোকোমো জাপান এই পরিকল্পনায় দ্রুত অগ্রসরমান। দরজা খুললেই স্বপ্ন হয়ে যাচ্ছে বাস্তব আর সেটাই জাপান!
এ আই, এটিএম, আইটির একুশ শতক:
A I, ATM প্রভৃতি অগ্রসর প্রযুক্তির ঢেউ এত দ্রুত ধেয়ে আসছে আধুনিক বিশ্বের দিকে যে তাকে আগলে দাঁড়ায় কে? সেই সাহস আর কারো নেই। কম্পিউটার, প্রোগ্রামিং আর ইন্টারনেট মানুষের জীবনব্যবস্থায় যে ধাক্কা দিয়েছে তাতে জন্ম হয়েছে বিশ্বায়নের। প্রযুক্তিই একমাত্র শিক্ষক যে ধনী-দরিদ্র, সুস্থ-অসুস্থ, মেধাবী-অমেধাবী, পাগল-অপাগলকে এককাতারে এনে দিচ্ছে। ধর্ম যা পারেনি, পারবেও না কোনোদিন।
AI–Artificial Intelligence, ATM–Automatic Teller Machine এবং IT–Information Technology এখন বিশ্বের ধনীদেশগুলোর মতো জাপানেও বহুল শ্রুত ও দৃশ্যমান। অও মানে সোজা কথায় রোবোটিক টেকনোলজি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, হাসপাতাল, বিমানবন্দর, রাস্তাঘাট, মহাকাশ গবেষণা-অভিযান এবং জীবনযাপন সবই রোবোটের দখলে চলে যাচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় স্বরযন্ত্র বা অঞগ চলছে ইউবিকটাস কম্পিউটিংএর মাধ্যমে। এতদিন জাপানের ব্যাংক এবং পোস্ট অফিসে এই মেশিন দেখা গেলেও এখন কনভিনিয়েন্স স্টোরগুলোতে যেমন সেভেন ইলেভেন, ফ্যামেলি মার্ট, লো সোন, সানকুস প্রভৃতি দোকানে এটিএম বিস্তৃতভাবে কাজ করছে। মোবাইল ফোন তথা স্মার্টফোন, আইফোন, ট্যাবলেট প্রভৃতি পিএইচডি (পার্সোনাল হ্যান্ডি ডিভাইস) দিয়ে আপনি আপনার নিত্য প্রয়োজনীয় টাকা তোলা ও পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারছেন। কাগুজে মানির দরকার হচ্ছে না। ষাটের দশকে জাপানে প্লাস্টিক মানি তথা ক্রেডিট কার্ড চালু হয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে এই এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। IT বদলে দিচ্ছে মুদ্রণ ও প্রকাশনার জগতকে বিস্ময়করভাবে! পত্রপত্রিকা প্রকাশ এখন ডালভাতের মতো সাধারণ ব্যাপার। যা বছর বিশেক আগেও অত সহজ ছিল না।
তবে দুশ্চিন্তার কথা যে, এই প্রযুক্তিগত অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয়তার কারণে বিলুপ্ত হতে বসেছে প্রায় ১০০ প্রকারের কাজ বা পেশা। তার মধ্যে, অফিসআদালতে কেরানির চাকরি, ম্যানেজার, সেলস ম্যানেজার, ডিসি, এডিসি, সেক্রেটারি, কম্পিউটার মেরামতকারী, টেলিফোন অপারেটিং, কল সেন্টার, ব্যাংকিং লেনদন, পোস্টাল সার্ভিস, সিকিউরিটি গার্ড, ড্রইভিং, ইনফরমেশন ডেক্স বা কাউন্টার, জমিজিরাতি বিক্রির দালালি, প্রিন্টিং প্রভৃতি। এমনকি, দলিললেখক, গ্রাফিক ডিজাইনার, পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক, সফট ডেভেলপার, হাতুড়ে ডাক্তার, অনভিজ্ঞ শিক্ষক প্রভৃতিও এই তালিকায় রয়েছে। তাহলে মানুষ কি বেকার হয়ে যাবে? সন্দেহ নেই যে, সেই অপ্রতিরোধ্য সম্ভাবনাই দেখা দিয়েছে। ধেয়ে আসছে ঝড়ের মতো। সেই ঝড়ে উড়ে যাবে পুরনো বিশ্বব্যবস্থা। তবে সবচে বড় পরিবর্তন দেখা যাবে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যাহ্রাসে। কারণ, জীবননির্বাহব্যয় লাগামহীন বেড়ে চলবে। বিশেষ করে, শিক্ষাখাত প্রচুর ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে। একটি সন্তানকেই সঠিকভাবে মানুষ করা কর্মরত দম্পতির জন্য নাভিশ্বাস হয়ে দাঁড়াবে। ব্যস্ততার কারণে বিবাহবন্ধন হ্রাস পেতে থাকবে, ধনী দেশগুলোতে এর লক্ষণ এখনই সুস্পষ্ট। ইন্টারনেটও এই ক্ষেত্রে অবাধ ভূমিকা রাখবে।
তবে আশার কথা যে, দুর্নীতির বারোটা বাজবে। এশিয়ায় ষাট-সত্তর দশকে জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স প্রভৃতি দেশ ছিল লুটপাট, আত্মসাৎ আর দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য–কিন্তু প্রযুক্তি, একমাত্র প্রযুক্তিই বদলে দিয়েছে এই দেশগুলোকে। বাংলাদেশও সেইদিকেই ধাবমান। ডিজিটাল রোবোট ঘুষখোর, চোর আর দুর্নীতিবাজকে সহজেই সনাক্ত করবে এবং তৎক্ষণাৎ শাস্তি দেবারও অধিকার রাখবে। সেই দৃশ্য দেখা সময়ের ব্যাপার মাত্র!
যুদ্ধবিষয়ক কমিক্স বা কার্টুনের হিড়িক:
মিজুকি শিগেরু একজন খ্যাতিমান ছেনসোও মানগাকা অর্থাৎ যুদ্ধবিষয়ক কার্টুনিস্ট। মানগা জাপানি শব্দ যাকে ইংরেজিতে কমিক্স বা কার্টুন বলা হয়। এর উৎপত্তি এদো যুগে (১৬০৩-১৮৬৮) মানে মধ্য যুগে। চারশ বছরের ধারাবাহিকতায় আজকের আধুনিক বিশ্ববিজয়ী মানগার বিবর্তন। জাপানি জীবনযাত্রার সঙ্গে মানগার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ককে আর কিছুতেই বিচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। ব্ল্যাক জ্যাক, ওতাকু প্রভৃতি মানগা জাপানের যা আমেরিকাকে কুপোকাত করে দিয়েছে। কার্টুন থেকে চলচ্চিত্র তথা অ্যানিমেশন যেমন ডিজনীর অ্যানিমেশন। জাপানও পিছিয়ে থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই মানগার জয়জয়কার ঘটে গেছে। যুদ্ধের পর ঘটেছে মানগা বিপ্লব! ‘মানগাহোলিক জাপানিজ’ বা ‘কার্টুনাসক্ত জাপানি’ বলে একটা কথা চালু হয়েছিল আশি-নব্বই এর দশক জুড়ে। কত যে কমিক্স ম্যাগাজিন ও গ্রন্থসিরিজ প্রকাশিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! আর কত বিষয়বৈচিত্র্য! পাল্লা দিয়ে যৌন-মানগা প্রকাশেরও সীমারেখা ছিল না! কী ব্যস্ততাই না ছিল শত শত প্রকাশনা ও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেসব নিজের চোখেই দেখা।
দৃশ্যটা বদলে যেতে লাগলো নব্বই দশকের শেষদিক থেকে। মানগাকে নাগরিক জীবনযাপনিক সুবিধার ক্ষেত্রে কীভাবে সহযোগী ভূমিকায় ব্যবহার করা যায় তাই নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে লাগলো। সফলও হলো এই চিন্তা। মানগা যেহেতু জাপানি জাতির সৃজনশীল চিন্তাচেতনার ঐতিহ্য তাই দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে মানগাকে ব্যবহার করা শুরু করলো বিবিধ প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের প্রতীক, ব্যাংকের প্রতীক, পণ্যসামগ্রীর প্রতীক, শিক্ষার প্রতীক, দিকনির্দেশনার প্রতীক, চিকিৎসাক্ষেত্রের প্রতীক, খাওয়াদাওয়ার প্রতীক, রান্নাবান্নার প্রতীক, রাস্তাঘাটে চলাফেরার প্রতীক, যানবাহনের প্রতীক, জাদুঘরের প্রতীক, সংবাদপত্রের প্রতীক, রিপোর্ট-প্রতিবেদনের প্রতীকÑÑহেন জিনিস নেই যেখানে মানগার বৈচিত্র্যময় ব্যবহার হচ্ছে না! এবং দেখা গেল যে, এই প্রবণতার প্রয়োজনও ছিল কারণ, মানুষের ক্রমবর্ধমান ব্যস্ততা, সময়ের অভাব, অহেতুক চিন্তাকরা থেকে পরিত্রাণ এবং বয়স্কসমাজ। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকাশিত হতে শুরু করলো ইহিতাসবিষয়ক মানগা! মানগার চিত্র দিয়ে ইতিহাস পাঠ ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা।
সাম্প্রতিককালে যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে সেটা হলো, যুদ্ধভিত্তিক মানগা রচনার হিড়িক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই এখন মানগার বিষয়। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, ঘটনাসমূহ, ডায়েরি, স্মারকবস্তু, স্মৃতিচিহ্ন, সাক্ষাৎকার প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে মানগা রচনা হচ্ছে। এটা যে দুদিক দিয়েই গ্রহণযোগ্য তা বলাই বাহুল্য, এক. শিক্ষামূলকÑÑযুদ্ধের সম্ভাব্য ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা অর্জন। দুই. প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের আগ্রহ। বয়স্কদের কাছে যুদ্ধকথা মানেই নিদারুণ স্মৃতিকাতরতা আর তরুণদের জন্য অদম্য রোমাঞ্চ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধও যে মানগার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করবে না অদূর ভবিষ্যতে বা বঙ্গবন্ধুসহ বিশ্বমাপের বাঙালির জীবন কমিক্স বা কার্টুনে চিত্রিত হবে না তা হলফ করে বলা যায় না। সেই সম্ভাবনা দুয়ারের কড়া নাড়ছে যেন।
জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক
প্রবীর বিকাশ সরকার