ইয়াসমিন হক সন্তোষ প্রকাশ করলেও অধ্যাপক জাফর ইকবালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা এবং প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন এখনো রয়েছে৷ হত্যার হুমকিপ্রাপ্তদের নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের আসলে তেমন আলাদা প্রশিক্ষণই দেয়া হয় না!
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার গোলাম কিরিয়া ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সব পুলিশ সদস্য যে প্রশিক্ষণ পায়, তাদেরও সেই প্রশিক্ষণই আছে৷ তারা রেগুলার ফোর্স৷”
শনিবার সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালেরও ওপর হামলার সময় মঞ্চে তাঁর পিছনে চার পুলিশ সদস্যও ছিলেন৷ কিন্তু চার জনের দু’জনই ছিলেন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত৷ ওই দু’জনকে এরইমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷
অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের নিরাপাত্তার ব্যবস্থা করা হয় ২০১৬ সালের ১২ অক্টোবরের পরে৷ ওই দিন তাঁকে ও তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন হককে এসএসএস-এ হত্যার হুমকি দেয়া হয়৷ তখন তাঁরা ঢাকায় ছিলেন৷ সিলেটে ফিরে জালালাবাদ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল৷
শনিবার হামলার পর জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমিন হক পুলিশের ভূমিকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন৷ তবে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার গোলাম কিবরিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘ওই দু’জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালনের সময় অসতর্ক ছিলেন৷ তারা মোবাইল ফোন চাপছিলেন৷ এ কারণেই তাদের সাসপেন্ড করা হয়েছে৷”
তিনি জানান, ‘‘অধ্যাপক জাফর ইকবালের নিরাপত্তার দায়িত্বে মোট ৩৬ জন পুলিশ রয়েছে৷ তারা পালাক্রমে ২৪ ঘন্টা দায়িত্ব পালনে করেন৷ তাঁর বাসা, কর্মস্থল সবখানেই নিরাপত্তা দেয়া হয়৷ তিনি বাইরে, এমনকি ঢাকায় গেলেও আমরা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করি৷ ওই টিমে একজন গানম্যনও আছে৷ শনিবার হামলার দিন নিরাপত্তার দায়িত্বে মোট পাঁচজন পুলিশ ছিলেন৷ তাদের সঙ্গে গাড়িও ছিল৷”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘জাফর ইকবাল স্যারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা মেট্রোপলিটন পুলিশের৷ তারা আলাদা কোনো ফোর্স নয়৷ পুলিশের যে প্রশিক্ষণ, তাদেরও সেই প্রশিক্ষণ৷ সবাইকে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে তাদেরও ঠকি সেই প্রশিক্ষণই আছে৷ তাদের ফায়ারিং প্রশিক্ষণও আছে৷”
তিনি বলেন, ‘‘আমরা স্যারের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছি সব সময়৷”
তবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ক্যাম্পাস সাংবাদিক জাহিদ হাসান জানান, ড. জাফর ইকবালের নিরাপত্তা আগের মতো জোরদার ছিল না৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘২০১৬ সালে যখন স্যারকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়, তখন স্যারের সঙ্গে সব সময় ১০-১২ জন পুলিশ থাকত৷ স্যারের বাসায়ও সব সময় পুলিশ থাকতো চার থেকে পাঁচজন৷ ধীরে ধীরে এই সংখ্যা কমে আসছিল৷ তবে স্যার নিজেও পুলিশ প্রটেকশন নিয়ে বিরক্ত ছিলেন৷ তিনি এটা চাইতেন না৷ তিনি মনে করতেন, এতে তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে৷”
সাধারণভাবে বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, মন্ত্রী, সচিব পুলিশ প্রটেকশন এবং গানম্যান পেয়ে থাকেন৷ সংসদ সদস্যরা সরাসরি গানম্যান পান না৷ তাঁরা চাইলে পান৷ এর বাইরে কেউ নিরাপত্তার জন্য গানম্যান বা পুলিশ প্রোটেকশন চাইলে তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়৷ তাদের আবেদনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সন্তুষ্ট হলে প্রয়োজন অনুযায়ী পুলিশ প্রোটেকশন বা গানম্যান দেয়া হয়৷
তবে স্বরষ্ট্রমন্ত্রণালয় ওই নিরাপত্তা দেয়ার আগে ‘থ্রেট অ্যাসেসমেন্ট’ করে৷ আর এই থ্রেট অ্যাসেসমেন্টের দায়িত্ব পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি)৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশেষ শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, ‘‘আমরা থ্রেট অ্যাসেসমেন্ট করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান, তাঁর ঝুঁকি কতটুকু, তাঁর ব্যক্তিগত ট্র্যাক রেকর্ড এসব খতিয়ে দেখি৷ আমাদের তদন্তে যদি মনে হয় তাঁর বাড়তি নিরপত্তার প্রয়োজন আছে, তাহলে আমরা গানম্যান বা পুলিশি নিরাপত্তা দেয়ার সুপারিশ করি৷ এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়৷ এই নিরাপত্তার খরচ পুরোটাই সরকার বহন করে৷ আর প্রয়োজন অনুযায়ী, গানম্যান ছাড়াও ওই ব্যক্তি যখন চলাফেরা করেন, তখনো আলাদা নিরাপত্তা দেয়া হয়৷”
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, ‘‘প্রাইভেটভাবে গানম্যান রাখার বিধান নাই৷ তবে কেউ যদি সন্তুষ্ট করতে পারেন, তাকে একাধিক আগ্নেয়াস্ত্রের লাইনেসন্স দেয় হয়৷ আর ওই আগ্নেয়াস্ত্র পরিচালনা বা বহন করা ব্যক্তিদেরও অনুমোদন দেয়া হয়৷ তখন যারা ধনী ব্যক্তি, তারা নিজের খরচে নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারেন৷”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘নিরাপত্তার জন্য গাণম্যান সাদাপোশাকে দেয়া হয়, আবার প্রটেকশন ফোর্স থেকে পুলিশও দেয়া হয়৷ আর এই কাজে যাদের দেয়া হয়, তারা কনস্টেবল থেকে সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) পর্যন্ত হতে পারেন৷ তাদের আগ্নেয়াস্ত্র পুলিশ বাহিনী থেকেই সরবরাহ করা হয়৷ গানম্যানদের ৩০ দিনের একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘শুধু আবেদন নয়, সরকার যদি মনে করে কারুর নিরাপত্তা বিধান করা জরুরি, তখন নিজ উদ্যোগেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়৷” অধ্যাপক জাফর ইকবালের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘তাঁর নিরপাত্তা সরকার স্ব- উদ্যোগেই নিয়েছে৷”
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাধারণভাবে মন্ত্রী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের পুলিশ প্রটেকশনের বিধিমালা আছে৷ সেই অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা করি৷ আর কেউ নিরাপত্তা চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বিধি অনুযায়ী আমরা তা করি৷ আমাদের প্রটেকশন ফোর্স আছে৷ সাধারণত সেখান থেকেই তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে দেয়া হয়৷’’
সুত্র ও সৌজন্যেঃ ডয়চে ভেলে