আমাদের বাঙালি জীবনে এমন কতিপয় ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁরা যুগের পর যুগ রোম্যান্টিক নায়ক হিসেবে স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন। তাঁরা হলেন স্বামী বিবেকানন্দ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভবিষ্যতে যত প্রজন্ম আসবে তাদের মনে রোমাঞ্চকর দোলা দিয়ে যাবেন তাঁরা। যেমন আমাদের কৈশোর ও তরুণকালে তাঁরা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছেন। প্রবীণদের ভাবনায়ও দেখেছি তাঁরা কখনো প্রবীণ হন না।
যেহেতু প্রসঙ্গটা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে তখন নিঃসঙ্গ রোম্যান্টিক একজন সেনাধ্যক্ষ আমার মাথার মধ্যে নড়েচড়ে ওঠেন। ১৯৪২ সালে যখন তিনি জার্মানির কিল বন্দর থেকে ডুবোজাহাজে করে পালিয়ে এসে জাপানি নৌবাহিনীর হাতে পড়লেন তখন জলযানে যেভাবে বসেছিলেন সেই মুখাবয়বটি দেখলে বুকটা কেমন করে ওঠে। মুখের ওপর এমন একটি আভাস ফুটে উঠেছিল সেটা স্পষ্টতই নির্দেশ করছিল: একদিকে বিদোশি শৃঙ্খল থেকে মাতৃভূমি ভারতকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়ার রোমাঞ্চ আর অন্যদিকে প্রিয়তমা পতœী এমিলি সেঙ্কেলকে জার্মানিতে একা ফেলে আসার কারণে অতলান্ত বিষণœতা। অস্ট্রিয়ায় জন্ম এমিলি ছিলেন তাঁরই ব্যক্তিগত সচিব। জাপানে আসার পর থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে জীবদ্দশায় তিনি আর দ্বিতীয়বার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি বলেই জানি।
যে তিনজন প্রবাসী মহাবিপ্লবী লড়াকু বীর যথাক্রমে রাসবিহাররী বসু, হেরম্বলাল গুপ্ত এবং সুভাষচন্দ্র বসু জাপানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য অমূল্য অবদান রেখে গেছেন তাঁদের তিনজনই দাম্পত্যজীবন উপভোগ করতে পারেননি। রাসবিহারী বসুই সুভাষ বসুকে জাপানে আনার ব্যবস্থা করেন। সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের (আইএনএ) এক সংবর্ধনা সভায় সুভাষ বসুকে তিনিই ‘নেতাজি’ উপাধিতে ভূষিত করেন বলে জানা যায়। আইএনএ-র দায়িত্বও নেতাজির হাতে অর্পন করেন বর্ষীয়ান অসুস্থ রাসবিহারী বসু। জাপানে মহাপ্রভাবশালী রাসবিহারী বসুর কূটনীতি এবং নেতাজির উত্থানই ভারতের স্বাধীনতাকে তরান্বিত করেছিল যা অনস্বীকার্য। নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রধান সেনাপতি হলে পরে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে। তৎকালীন জাপানে প্রধানমন্ত্রী ও যুদ্ধমন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকি ও নেতাজির মধ্যে সহযোগিতা ও সমঝোতা চুক্তিরও আয়োজন করেন নেপথ্যে থেকে রাসবিহারী বসু।
তারপর পরিকল্পনা অনুসারে ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী ইম্ফল অভিযানে নেতৃত্ব প্রদান করেন নেতাজি ১৯৪৫ সালে। তখন তুমুলভাবে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু আগস্ট মাসে জাপান হঠাৎ করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা দিয়ে মিত্রশক্তি আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পন করলে মনিপুর প্রদেশের সন্নিকটস্থ ইম্ফল সামরিক অভিযান ব্যর্থ হয়। তারপরেও নেতাজির নির্দেশে যুদ্ধ করতে থাকেন ভারতীয় সেনারা। কিন্তু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলে রসদ দরকার, বিপুল ভারী অস্ত্রশস্ত্র দরকার, অর্থকড়িও প্রয়োজন। নেতাজি রাশিয়ার কথা ভাবলেন। ভিয়েতনাম থেকে একটি ক্ষুদ্র জাপানি যুদ্ধবিমানে করে তাইওয়ান হয়ে রাশিয়ার পথে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে জ্বালানি সংগ্রহ করে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপের মাৎসুয়ামা বিমানবন্দরে এক দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট বলে নেতাজির প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও গ্রন্থাদি থেকে জানা যায়। নেতাজির জাপানি সহকর্মী ও ভক্তরা তাঁর চিতাভস্ম জাপানে বয়ে নিয়ে এলে নেতাজির আরেক ভক্ত টোকিওর সুগিনামি ওয়ার্ডের রেনকোজি বৌদ্ধমন্দিরের প্রধান পুরোহিত রেভারেন্ড মোচিজুকি সেই চিতাভস্ম মন্দিরে সংরক্ষণ করেন এই প্রতীজ্ঞতায় যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে পরে নেতাজির পবিত্র চিতাভস্ম জন্মভূতিতে ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু নানা রকম জটিলতার কারণে আজও নেতাজির চিতাভস্ম জাপানেই রয়ে গেছে। প্রতিবছর ১৮ তারিখে নেতাজির প্রয়াণ দিবসে জাপানি পদ্ধতিতে স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় মন্দির কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে। আগে আয়োজন করত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু একাডেমীÑÑএটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নেতাজি ভক্ত হায়াশিদা তাৎসুও, হায়াশি মাসাও, মেজর ইতাকুরা প্রমুখের উদ্যোগে ১৯৫৮ সালে। প্রায় ১০০ জন প্রবীণ নেতাজি ভক্ত সদস্য ছিলেন। কালক্রমে একে একে অনেকেরই মৃত্যু হওয়ার কারণে এখন একাডেমী বিলুপ্ত। নেতাজি জাপানে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন স্বাধীনতার বীরসৈনিক কাজেই যতদিন তাঁর চিতাভস্ম জাপানে আছে ততদিন মন্দির কর্তৃপক্ষ স্মরণসভার আয়োজন করে যাবে।
এখনো প্রতি বছর ১৮ আগস্ট মন্দিরের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হয় নেতাজি ভক্তদের জন্য। প্রায় ৭০-৮০ জন নেতাজি ভক্ত জাপানি নাগরিক মন্দিরে এসে প্রার্থনা করেন তারপর মধ্যাহ্নভোজে অংশগ্রহণ করে নেতাজি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ এবং আলোচনা করেন। ভারতীয় দূতাবাস থেকে উপরাষ্ট্রদূত উপস্থিত থাকলেও বাংলাদেশ দূতাবাসের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেন না। সেখানে বিগত এক যুগ ধরে আমি অংশগ্রহণ করার ফলে একাধিক নেতাজি ভক্তের সঙ্গে পরিচয় ঘটে যাঁরা নেতাজির সঙ্গে কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে ক্যাপ্টেন ফুজি, হায়াশি মাসাও, বার্মায় নেতাজির দেহরক্ষী ইয়ামাদা কাঅরু প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কেউ কেউ নেতাজিকে নিয়ে গ্রন্থও লিখেছেন। গবেষণা করছেন যেমন তেইকোকু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গেন্ নাকামুরা। কেউ কেউ নেতাজি প্রদত্ত উপহার স্মৃতি হিসেবে নিয়ে আসেন। দীর্ঘক্ষণ তারা আবেগঘন কন্ঠে নেতাজির তেজস্বিতা, বুদ্ধিমত্তা, সুনেতৃত্ব, অমায়িক ব্যবহারের কথা বার বার ব্যক্ত করেন। আলোচনা এত জীবন্ত যে মনে হয় যেন নেতাজি তখন তাঁদের চোখের সামনে আছেন! শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে তাঁদের মাথা নুয়ে আসে।
এটা সত্যি যে নেতাজির মৃত্যু নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক, বিভ্রান্তি ও সন্দেহ। নেতাজির পরিবার তো এখনো বিশ্বাস করে নেতাজি মারা যাননি, হিমালয় পর্বতের কোনো গুহায় তপস্যা করছেন শতবর্ষী বয়সেও! কিন্তু নেতাজির কন্যা অনিতার বিশ্বাস নেতাজি তাইওয়ানেই বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন, এবং ভারত সরকারকে বারংবার অনুরোধ করে আসছেন তাঁর পবিত্র চিতাভস্ম স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করার জন্য। কিন্তু ভারত সরকার তেমন গা করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর পেছনে প্রধান কারণই হচ্ছে ধর্মীয় বলে কোনো কোনো জাপানি গবেষকের বিশ্বাস। কাজেই নেতাজি এখনো প্রবাসী।
১৯৯৫ সালে সুভাষচন্দ্র একাডেমী জাপান নেতাজির ৫০তম তিরোধান দিবস স্মরণে বর্তমান ধাতব মূর্তিটি মন্দিরের প্রাঙ্গণে স্থাপন করে। প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী জাপান সফরে এলে পরে তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ-বাণী পাথরে খোদাই করা হয়। এই স্মারক মূর্তিটি দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ভারতীয় আসেন এবং শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে যান। কিন্তু বাংলাদেশীদের পদধূলি পরে কদাচিৎ। আমি যে ক’জন বাংলাদেশীকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম তাঁরা হলেন সাংবাদিক চিত্ত রিবেরু, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি ও সাংবাদিক সমুদ্র গুপ্ত, এফবিসিসিআই এর প্রাক্তন সহসভাপতি দেওয়ান সুলতান আহমেদ, লেখক, গবেষক ও ঢাকা জাদুঘরের প্রাক্তন মহাপরিচালক সমর পাল, লেখক ও অনুবাদক ফখরুজ্জামান চৌধুরী, লেখিকা ও অভিনয়শিল্পী দিলালা জামান, লোকসাহিত্য গবেষক ও বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান প্রমুখ।
জানা যায় বাংলাদেশের কোনো প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত রেনকোজি মন্দিরে যাননি নেতাজিকে শ্রদ্ধা জানাতে। কোনো কোনো অর্বাচীন আওয়ামী নেতাÑÑ‘নেতাজি এখন ভারতীয় নাগরিক’ বিধায় সেখানে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলেও মন্তব্য করেন। তাহলে তো রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকেও অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে হয়! ১৯৫৭ সালে জওহরলাল নেহেরু যখন কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে প্রথম জাপান সফরে আসেন রেনকোজি মন্দিরে পা রেখেছিলেন, মন্তব্যখাতায় যে মন্তব্য লেখেন তাতে নেতাজির কোনো প্রসঙ্গই নেই, ভগবান বুদ্ধের কথা কয়েক লাইন লিখে রেখে গেছেন যেটা এখন একটি কাঁচের ঘেরে বাঁধানো আছে। এই সেদিনও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা নেতাজিকে ‘তোজোর কুকুর’ বলতেন’ অথচ তোজো ও নেতাজির যৌথ লড়াইয়ের ফলেই ভারত তার আরাধ্য স্বাধীনতা লাভ করেছিল, না করলে বামরা ক্ষমতায় যেতে পারত না কোনোদিন। এখন অবশ্য তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। কলকাতায় নেতাজির নামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়েছে।
অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের কাছেও নেতাজি নতুন করে উঠে আসছেন এটা শুভদিক। সত্যিকার জাতীয়তাবাদ কাকে বলে তাঁর কাছ থেকেই শিখতে হবে বলে কোনো কোনো তরুণ জাপানি ভক্তের মন্তব্য শোনা যায়। ইতিহাস সচেতন জাপানিদের চেতনা থেকে নেতাজিকে মুছে ফেলা সহজে সম্ভব হবে না। জনৈক জাপানি গবেষক একবার নেতাজির স্মরণসভায় বলেছিলেন, ‘যতদিন বাঙালি ও জাপানি জাতি থাকবে ততদিন নেতাজিও থাকবেন।’
Check Also
১৫ই আগষ্ট আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন জাপানি নভোচারী ফুরুকাওয়া
জাপানের নভোচারী ফুরুকাওয়া সাতোশির দ্রুত হলে ১৫ই আগষ্ট আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে দ্বিতীয় ভ্রমণ নির্ধারণ করা …