ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিপ্লবী মহানায়ক রাসবিহারী বসু (১৮৮৬-১৯৪৫) আজ জাপানে এক কিংবদন্তী পুরুষ। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় জন্ম (১৮৮৬) ১৫ বছর বয়স থেকেই স্বাধীনতা মন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। তরুণ বয়সে এই বাঙালি বীর ভারতে বৃটিশ উপরাজ লর্ড হার্ডিঞ্জকে (Lord Hardinge, the Viceroy of India from 1910 to 1916) হত্যা এবং আরেকটি সিপাহী বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে মহাষড়যন্ত্র করেছিলেন যা ইতিহাসে দিল্লী-লাহোর ষড়যন্ত্র (উবষযর-খধযড়ৎব ঈড়হংঢ়রৎধপু, ১৯১২) নামে খ্যাত। দুর্ভাগ্যক্রমে দুটো পরিকল্পনাই বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে রাসবিহারী বসু জাপানে পালিয়ে আসেন ১৯১৫ সালে। তখন তাঁকে ধরিয়ে দেবার জন্য তাঁর মাথার উপর তৎকালীন বৃটিশ সরকারের ১২,০০০ রুপী তথা ৫ হাজার বৃটিশ পাউন্ডের মহাপুরস্কার ঝুলছিল।
তাঁর আগমনের কয়েক মাস পর আসেন আর এক দুর্ধর্ষ বিপ্লবী হেরেম্বলাল গুপ্ত একই পুরস্কারের অঙ্ক মাথায় নিয়ে। তাঁদের দুজনকে জাপানি পুলিশের হাত থেকে রক্ষার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রভাবশালী গণমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা রাজনীতিক এবং ‘গেনয়োশা’ নামক গুপ্ত সমিতির পরিচালক গুরু তোয়ামা মিৎসুরু (১৮৫৫-১৯৪৪)। তাঁকে আরও যাঁরা সহযোগিতা করেন এবং পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন তাঁরা হলেন কুজো য়োশিহিসা, উচিদা রিয়োহেই, ওওকাওয়া শুমেই, সুগিয়ামা শিগেমারু, ইয়াসুওকা মাসাহিরো, শিমোনাকা ইয়াসাবুরো, কিমুরা নিক্কি, ওওকুরা কুনিহিকো, ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি, য়োশিদা শিগেরু প্রমুখ প্রভূত প্রভাবশালী আদর্শবান এশিয়াবাদী (প্যান-এশিয়ানিস্ট) রাজনীতিকবৃন্দ। তাঁদের আগমনের কয়েক মাস পর জাপান সফরে আসেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের চরমপন্থী নেতা, ভয়ঙ্কর বিপ্লবী বলে পরিচিত লালা লাজপত রায় (১৮৬৫-১৯২৮)। রাসবিহারী বসু তাঁর আগমনকে উপলক্ষ করে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করতে মনোস্থির করেন। কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অর্থাৎ তিনি চাচ্ছিলেন জাপানি সমাজে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচার করতে যাতে করে জাপানি নাগরিকরা প্রবাসী বিপ্লবীদেরকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে, পাশাপাশি ভারতে বৃটিশের অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যদিও জাপান তখন ইংল্যান্ডের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তিতে আবদ্ধ।
ইতিমধ্যে হেরেম্বলাল গুপ্তের সঙ্গে তখনকার প্রখ্যাত প্যান-এশিয়ানিস্ট এবং ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের গবেষক তুখোড় তরুণ বুদ্ধিজীবী ওওকাওয়া শুমেই এর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি গভীরভাবে সহানুভূতিশীল ছিলেন। সম্ভবত তাঁরই পরামর্শে উয়েনো শহরের বিখ্যাত সেইয়োকেন্ মিলনায়তনে সম্রাট তাইশো (১৯১২-২৬) এর সিংহাসন আরোহণকে কেন্দ্র করে একটি অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে মূল লক্ষ্য অনুসারে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন লালা লাজপত রায়, রাসবিহারী বসু, হেরেম্বলাল গুপ্ত। তোয়ামা মিৎসুরুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন।
এই অনুষ্ঠানে বৃটিশ দূতাবাসের কতিপয় গুপ্তচর উপস্থিত ছিল তারা যথা সময়ে বিবরণ উপস্থাপন করে রাষ্ট্রদূতকে। পরের দিন বৃটিশ দূতাবাস জাপান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে বিপ্লবীদেরকে ধরিয়ে দেবার জন্য। সরকার বাধ্য হয়ে তাঁদেরকে জাপানত্যাগের নির্দেশ জারি করে। লালা রাজপৎ রায় আমেরিকা চলে যান। রাসবিহারী এবং হেরেম্বলালকে গুরু তোয়ামা আশ্রয় প্রদান করেন। তাঁদেরকে তাঁর বাড়ির কাছেই শিনজুকু শহরে অবস্থিত সুবিখ্যাত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘নাকামুরায়া’র কর্ণধার সোমা আইজোর সঙ্গে আলাপ করে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে একটি পরিত্যক্ত ছবি আঁকার স্টুডিও ভবনে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু কিছুদিন পর পুলিশ ঠিকই তাঁদের গুপ্ত অবস্থান জানতে পারে। এর মধ্যে হেরেম্বলাল গৃহবন্দী অবস্থায় অস্থির হয়ে বেরিয়ে পড়েন এবং ওওকাওয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। মাস চারেক সেখানে থাকার পর আমেরিকায় চলে যান। এদিকে যখন রাসবিহারী বসুকে আর কিছুতেই পুলিশের নজর থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না তখন তোয়ামা মিৎসুরু সোমা আইজোকে তাঁর জ্যেষ্ঠকন্যা তখন ছাত্রী তোশিকো সোমার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেন। অপ্রত্যাশিত এই প্রস্তাবে সোমা দম্পতি মহাবিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। কিন্তু তাঁদেরকে রক্ষা করেন তোশিকো নিজেই এগিয়ে এসে। প্রস্তাবিত বিয়েতে তিনি রাজি হন। বলেন, ‘মি.বোস স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য জাপানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁকে সহযোগিতা করতে চাই, আমাকে তাঁর কাছেই যেতে দাও।’
কিন্তু বিয়ের পরও কয়েক বছর বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে জীবন যাপন করতে হয়েছে তাঁদেরকে। শাশুড়ি সোমা কোক্কোর ডায়েরি থেকে ১৭ বার বাসা বদলের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে দুসন্তানের জনক হন রাসবিহারী বসু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর য়োরোপে শান্তি স্থাপিত হয়। রাসবিহারী বসুরও পলাতক জীবনের ইতি ঘটে। জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করে মুক্তির আলোয় বেরিয়ে আসেন। কিন্তু দাম্পত্য সুখ বেশি দিন ভাগ্যে সইল না। পলাতক জীবনে স্ত্রী তোশিকোকে অমানবিক কষ্ট সহ্য করতে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন জায়গায়, পর্যাপ্ত আলো-বায়ুহীন পরিবেশে সংসার ও সন্তান লালন-পালন করতে গিয়ে। লাগাতার জ্বরজারি থেকে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ভুগে ১৯২৬ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে পরলোকে যাত্রা করেন। ধরায় রেখে যান প্রাণপ্রিয় স্বামী ও দুটি শিশুসন্তানকে। পরলোকগত স্ত্রীর ভালোবাসার সম্মানার্থে রাসবিহারী বসু আর বিয়ে করেননি বাকি জীবনে। পতœীবিয়োগের পরের বছর নাকামুরায়া প্রতিষ্ঠানের দ্বিতলে ভারতীয় কারি রেস্টুরেন্ট ‘ইন্দো নো মোন’ বা ‘ভারতীয় তোরণ’ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। ৮০ বছর পেরিয়ে এই কারি রেস্টুরেন্ট এখনও ‘নাকামুরায়া নো কারেএ’ নামে জাপানে জনপ্রিয়। রাসবিহারী বসুই প্রথম জাপানে ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় মশলায় রাঁধা মুরগি-মাংশের কারি প্রচলন করেন। একই ধরনের সুস্বাদু কারি আজও জাপানি পাচক উপহার দিচ্ছেন প্রতিদিন। ভারত বাংলাদেশের মানুষ যাঁরা তাঁপর সম্পর্কে জানেন এই রেস্টুরেন্টে এসে উক্ত কারির স্বাদ গ্রহণ এবং রাসবিহারী বসুকে স্মরণ করেন তবে তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই আঙুলে গোনার মতো।
এই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এখানে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থনকারী জাপানি রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ আলাপ-আলোচনায় বসতেন। অবশ্য অন্যান্য প্রবাসী ভারতীয়রাও আসতেন বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে।
ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনে জাপান প্রবাসী রাসবিহারী বসুর অবদানের কথা বলতে গেলে এটাই শুধু বলতে হয় যে, তিনি না এলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কোন্ পথে যেত এবং কবে স্বাধীনতা আসত বলা মুশকিল। মূলত তাঁর প্রচেষ্টার জোরেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জাপানে আহুত হয়েছিলেন। তাঁর হাতেই সমর্পন করেছেন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের (ILL:Indian Independence League) সভাপতির দায়িত্ব। আজাদ হিন্দ ফৌজ (INA: Indian National Army) মূলত তাঁরই পরিকল্পনা ও উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল ১৯৪২ সালেই পরে সুভাষচন্দ্র বসু যার অধিনায়ক হন। এবং এই উপলক্ষে সিঙ্গাপুরে আয়োজিত এক মহাসভায় রাসবিহারী বসুই সুভাষ বসুকে ‘নেতাজি’ প্রদান করেন বলে কথিত আছে। তিনি গোঁড়া থেকেই গান্ধীকে ভক্তি করলেও তাঁর অহিংসানীতির উপর আস্থা রাখতে পারেননি। মনে মনে গান্ধীর বিকল্প একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধিনায়কের প্রত্যাশায় ছিলেন। সেই অধিনায়কই হচ্ছেন সুভাষচন্দ্র বসু। যাঁর সঙ্গে ১৯৩৮ সাল থেকেই রাসবিহারী যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিলেন। এবং ১৯৪০ সালে গান্ধীকে ‘গতকালের লোক’ বলে অভিহিত করে ‘আজকের অবিসংবাদিত নেতা’ হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুর নাম ঘোষণা করেন। চরমপন্থী রাজনীতিক সুভাষ বসু শক্তিশালী ‘হিন্দুমহাসভা’র প্রতিষ্ঠাতা (১৯১৫) গান্ধী-কংগ্রেসবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী বিপ্লবী বীর দামোদর সাভারকার এর পরামর্শে ভারতত্যাগ করে জার্মানী গিয়েছিলেন। একমাত্র বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৪৩ সালে জাপানে আগমন করেন। পরবর্তীতে নেতাজি গঠিত স্বাধীন ভারত সরকার (Free India Government/Provisional Government) এর তিনি ছিলেন উপদেষ্টা। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের অবসান ঘটে ১৯৪৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে মাসাহিদে বোস জাপানি সৈন্য হিসেবে ওকিনাওয়া যুদ্ধে মিত্রশক্তি মার্কিনী সেনাদের হাতে প্রাণ হারান। মেয়ে তেৎসুকো (বসু) হিগুচি জনৈক প্রকৌশলীকে বিয়ে করে বর্তমানে বার্ধক্য জীবন অতিবাহিত করছেন। একবারও যেতে পারেননি স্বাধীন পিতৃভূমিতে। কেন যেতে পারেননি সেও এক রহস্য। স্বাধীন ভারতের কোনো রাজনীতিক তাঁকে তাঁর পিতৃভূমিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কিনা জানি না, জানালে নিশ্চয়ই তিনি যেতেন। তবে মেয়ে তথা রাসবিহারীর পৌত্রী মাতামহের জন্মস্থান একবার ঘুরে এসেছেন ব্যক্তিগতভাবে। সম্প্রতি বিশিষ্ট ভারত-বিষয়ক গবেষক নাকাজিমা তাকেশি তেৎসুকো হিগুচির মুখে শোনা তাঁর পিতার কাহিনী একটি চমৎকার গ্রন্থ ‘চিচি বোউসু’ বা ‘পিতা বসু’-এ লিপিবদ্ধ করে মহৎ কাজ সম্পাদন করেছেন। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবন সত্যি একটি শিক্ষামূলক অথচ বৈচিত্রময় উপন্যাস বললে অত্যুক্তি হয় না, যা চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত হলে পরে তরুণ প্রজন্মকেই শুধু স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ করবে না, বাংলাদেশের তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদী’দের জন্যও শিক্ষণীয় হবে সন্দেহ নেই। ন্যাশনালিস্টরা যে চোর হয় না, জনগণের সম্পদ লুন্ঠনকারী নয়ÑÑএকমাত্র নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠেন জীবনের প্রথম থেকেই তার আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জীবন, কূটনীতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষা। তাঁর নীতিজ্ঞান ছিল অত্যন্ত খাঁটি যেমন স্বধর্ম হিন্দুধর্মের প্রতি ছিলেন একনিষ্ঠ তেমনি স্বদেশপ্রেমে তেজস্বী। তাঁর প্রখর প্রবল আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ তাঁকে আজীবন সশস্ত্রবিপ্লবের প্রতি অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়েছিল। ১৯৩৫ সালে তিনি বিশ্ব আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নিজেও গবেষণা করেছিলেন মূলত বিশ্বসংস্কৃতিকে অনুধাবন এবং শুধু এশিয়ার পরাধীন মানুষের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণার্থে তাঁর উদ্যোগের ইতিহাস অপ্রচারিতই থেকে গেছে।
রাসবিহারী বসু মৃত্যুর পর ৬৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু আজও তিনি প্রবীণ জাপানিদের মনে বিখ্যাত ‘ইনদো শিশি’ বা ‘ভারতীয় বীরপুরুষ’ ভাবমূর্তিতে অধিষ্ঠিত। টোকিওর প্রাণকেন্দ্র শিনজুকু শহরস্থ ‘নাকামুরায়া’ মানেই রাসবিহারী বসু। প্রতিষ্ঠানের দ্বিতলে রেস্টুরেন্টের প্রবেশপথেই স্থাপিত শোকেসে তাঁর ও পরিবারের আলোকচিত্র রক্ষিত আছে। কিন্তু বাঙালি জানে না তাঁর ইতিহাস। আজকে এই যে দুই বাংলা থেকে হাজার হাজার বাঙালি জাপানে এসে কাজ করছে, ব্যবসা করছে এবং স্বদেশী সংস্কৃতি বিকাশে সংগঠন-সমিতি প্রতিষ্ঠা করছে এই ধারার সূচনা করেছিলেন তিনি। ১৯৩৩ সালে শিনজুকু শহরে ‘এশিয়া হাউস’ নামে একটি ৮ কক্ষবিশিষ্ট দ্বিতল রেস্টহাউস স্থাপন করেছিলেন সেখানে ৫৮ জন এশিয়ান বসবাস করতেন। এখানে এশিয়ার মুক্তি, জাপানের সঙ্গে এশিয়ার ভাতৃবন্ধন, সাংস্কৃতিক বিনিময় ইত্যাদি বিষয়ক সভা, আলোচনা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি পান-ভোজনাদি অনুষ্ঠিত হত। তখনকার বিখ্যাত একাধিক জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক পর্যন্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসতেন। রাসবিহারী বসু জাপানস্থ ভারতীয়সহ এশিয়ানদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য কারি ভোজ দিয়ে আমন্ত্রণ জানাতেন। অবশ্য জাপানি খাবার-দাবার যে ছিল না তা নয়। তবে ‘নাকামুরায়া’ প্রতিষ্ঠানের দুতলায় নিজস্ব ভারতীয় রেস্টুরেন্টে তাঁর নিজের হাতে তৈরি ‘ইন্ডিয়ান কারি-রাইস’ খাবারের সুনাম ইতিমধ্যে টোকিওসহ বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে ‘এশিয়া হাউসে’ সভা মানেই ভারতীয় কারি, তৈরি করবেন ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসুÑÑএই ঘটনা শহরব্যাপী মুখরোচক সংবাদে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ছিল।
শুধু তাই নয়, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রবাসী ভারতীয়দেরকে একত্রিত করার জন্য তিনি ‘ভারত মৈত্রী সমিতি’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু যে ভারতীয়রা আসতেন তা নয়, ভারত, এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রহী জাপানিরাও আসতেন। আলাপ-আলোচনা এবং পান-ভোজনাদি হত বেশ ঘটা করে। প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালের ৩০ শে জুন তারিখে তাঁর রেস্টুরেন্টের ভিতরেই। তাতে ৩১ জন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে তৎকালীন জাপানের আন্তর্জাতিক কবিÑÑরবীন্দ্রনাথের বন্ধু নোগুচি য়োনেজিরো বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সমিতির সর্বমোট ১০টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সমিতি থেকে ১৯৩৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের সম্মেলনে জাপান থেকে একজন প্রতিনিধি প্রেরণের সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়। আবার ভারত থেকে বিশেষ অতিথি কেউ এলে তাঁর স্মরণে বিশেষ সভারও আয়োজন করেছেন। যেমন জাপানস্থ প্রাচ্য গবেষণা সংস্থায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ বিনয়কুমার সরকার; জাপান সফরে এসেছিলেন স্বনামখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষু রাষ্ট্রপাল সান্ধিরিয়া; বিশ্বভারতীর জনৈক শিল্পী-অধ্যাপকও এসেছিলেন বলে জানা যায়, তাঁরা বিশেষ সভায় আলোচনা ও বক্তৃতা করেন।
নানাবিধ কাজের পাশাপাশি রাসবিহারী বসু নিয়মিত লেখালেখিও করতেন। ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, লোকসাহিত্য এবং ভারতে বৃটিশের শাসন-শোষণ নিয়ে অনেক লেখা জাপানি জাতীয় দৈনিক, সাময়িকী ও সংকলনে প্রকাশ করেছেন। তবে অধিকাংশই জাপানি ভাষায়। সারা জাপান ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে অবরুদ্ধ, শোষিত মাতৃভূমির রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দুরবস্থার ইতিহাস তুলে ধরেছেন জাপানিদের সামনে। জাপানে এশিয়ানদের বিরুদ্ধে জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এশিয়ানদের মুখপত্র হিসেবে নিজব্যয়ে মাসিক ‘নিউ এশিয়া’ নামে একটি তথ্যভিত্তিক কাগজ প্রকাশ করেছিলেন কিছুদিন। স্বনামে ও যৌথভাবে প্রায় ১৫/১৬টি গ্রন্থ লিখে রেখে গেছেন। যার মধ্যে গ্রন্থিত আছে মূল্যবান বিস্তর তথ্য ও ঘটনা। গ্রন্থগুলোর মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন। চরমপন্থী বিপ্লবী হলেও তিনি যে রোমান্টিক ছিলেন তাতে প্রমাণিত হয়। কবিগুরুর সঙ্গে তাঁর জাপানে একাধিকবার সাক্ষাৎ ঘটে। তাঁকে ঘটা করে সংবর্ধনা দেন। ১৯২৪ সালের জুন মাসের একদিন তাঁর বাড়িতে এসে পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। বিশ্বভারতীর জন্য চাঁদা তুলে কবির হাতে দেন। স্ত্রীর মাসতুতো বোন মাকি হোশিকে শান্তিনিকেতনে পাঠান ইকেবানা ও চা-অনুষ্ঠানের প্রশিক্ষক হিসেবে। ১৯২৯ সালে কবিগুরু ক্যানাডা থেকে ফেরার পথে জাপানে কিছুদিন বিশ্রাম নেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে টোকিয়োতে তাঁর তিন সপ্তাহকাল বসবাসের ব্যবস্থা করেন রাসবিহারী।
রবীন্দ্রনাথের অশেষ আশীর্বাদ পেলেও একটি বিষয়ে তাঁর সহানভূতিলাভে ব্যর্থ হন। ১৯৩১ সালে চীনের মাঞ্চুরিয়া জাপান আক্রমণ করলে রবীন্দ্রনাথ মনঃক্ষুন্ন হন, এই অপ্রত্যাশিত সামরিক অভিযানের কঠোর সমালোচনা করেন। ১৯৩৭ সালে যখন চীন-জাপান দ্বিতীয় যুদ্ধ বাঁধল তাতে রবীন্দ্রনাথসহ ভারতের অনেক রাজনীতিবিদ প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় তোলেন জাপানের বিরুদ্ধে। প্রকৃতপক্ষে, মাঞ্চুরিয়ার আসল ইতিহাস ও ঘটনা এবং দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধের পটভূমি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছুই জানতেন না বলে অনেক গবেষকরা মনে করেন। তাঁর কানে ভুল তথ্য দিয়ে থাকবেন তখন শান্তিনিকেতনে অবস্থানরত চীনা ভবনের শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রীরা কোন কোন গবেষকদের ধারণা। যাহোক, চীন আক্রমণ নিয়ে ভারতে যখন জাপান-বিরোধী প্রতিবাদ তুঙ্গে তখন জাপানিরাও মনঃক্ষুন্ন হলেন। ২০ বছরের পুরনো বন্ধু কবি নোগুচি য়োনেজিরো এই সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পত্রযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সবচেয়ে বেশি নিরাশ হন রাসবিহারীকে সুদীর্ঘ ২১ বছর ধরে যে সকল প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছিলেন ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে তাঁরা। রাসবিহারী বসু এই মহাসংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃত ঘটনা বুঝিয়ে বলার জন্য তাঁকে ১৯৩৮ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে জাপানে আসার আমন্ত্রণপত্র পাঠান জাহাজ ভাড়াসহ ৫০,০০০ ইয়েন বাজেটসহ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রস্তাবে রাজি হননি, উত্তরে তিনি লিখেন, ‘দীর্ঘ ভ্রমণের ফলে আমার শরীর উত্তম পর্যায়ে নেই। কিন্তু জাপানের প্রতি আমার যে মিশন তা বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত আয়োজন করে থাকলে তোমার প্রস্তাব বিবেচনা না করলে নয়। আমার মিশন হচ্ছে, এখন এশিয়ার যে মহা দুটি জাতি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তাদের মধ্যে সংস্কৃতি ও মৈত্রী সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু জাপানি কর্তৃপক্ষ আমাকে মুক্তচিত্তে চলার ও বলার সুযোগ দেবে কিনা এই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। কাজেই জাপান ভ্রমণ করে ছলচাতুরীর মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝির কারণ হতে চাই না। তথাপি জাপানের প্রতি আমার সত্যিকার ভালোবাসা বহন করছি।’ এই কারণে অনেক ভারতীয় ও বাংলাদেশী রাসবিহারী বসুকে জাপানের দালাল বলে কটাক্ষ করেন যা কিনা অজ্ঞতার পরিচায়ক ছাড়া আর কিছু নয়। যাঁরা ইতিহাস সচেতন তাঁরাই তাঁকে বীর দেশপ্রেমিক হিসেবে সম্মান করেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। রাসবিহারী বসুর জাপানে জীবিত ৩০ বছরের ঘটনাবহুল জীবনের সুদীর্ঘ ইতিহাস সত্যিই আকর্ষণীয়।
মৃত্যুর পূর্বে মহা পূর্ব-এশিয়া যুদ্ধ তথা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখার মূল্যায়ন স্বরূপ সম্রাট হিরোহিতো সর্বোচ্চ রাজকীয় সম্মাননা-পদক প্রদান করেন রাসবিহারী বসুকে। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করতে আগ্রহী হননি বলে কন্যা তেৎসুকো জানাচ্ছেন। মৃত্যুর পর সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে সেটা পাঠানো হয় রাসবিহারীর বাড়িতে। এই রকম রাজকীয় সম্মান পেয়েছেন আরেক জন বাঙালি দূরপ্রাচ্য টোকিও আন্তর্জাতিক সামরিক বিচার তথা টোকিও ট্রাইবুনালের (১৯৪৬-১৯৪৮) অন্যতম বিচারপতি বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় জন্ম ড.রাধাবিনোদ পাল ১৯৬৬ সালে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকেও জাপান সরকার অনুরূপ পদক প্রদানের পরিকল্পনা করেছিলেন নেতাজি বিনীতভাবে তা প্রত্যাখান করেন।
Check Also
১৫ই আগষ্ট আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন জাপানি নভোচারী ফুরুকাওয়া
জাপানের নভোচারী ফুরুকাওয়া সাতোশির দ্রুত হলে ১৫ই আগষ্ট আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে দ্বিতীয় ভ্রমণ নির্ধারণ করা …