অনুবাদ : সৈয়দ শামসুল হক
পথিকের দুঃস্বপ্ন অথবা মনোয়ারার স্বপ্ন
অথবা ফিদেল কাস্ত্রোকে অভিবাদন
কতকাল থেকে কতদিন থেকে
চলেই চলেছি আমি।
এখন অনেক রাত হয়ে গেছে
এখানে একটু থামি।
ওই দ্যাখা যায় জানালায় আলো,
হঠাৎ খামারবাড়ি।
কতকাল ঘুম হয়নি আমার –
দরোজায় কড়া নাড়ি।
দরোজাটা খুলে বেরিয়ে যে আসে
হাতে তার রামদা’!
মারমুখো তার ভঙ্গিটি আর
আমার আমতা আমতা।
রামদা’ ঠেকিয়ে আমার বুকে সে
বলে ভয়ানক স্বরে,
‘বাছাধন, আমি কোথাও তোমাকে
দেখেছি যে মনে পড়ে।
তুমি রাজনীতি কর মনে হয়,
বাম দিকে যেন ঝোঁক।’
ঢোঁক গিলে আমি বলি তাড়াতাড়ি,
‘ভুল করছেন লোক!
আমি তো পথিক, আমার এছাড়া
পরিচয় কিছু নেই।
শুধু এ রাতের আশ্রয় চাই –
আগমন হেতু এই।’
দুচোখ নাচিয়ে উঁকি দেয় মেয়ে,
মনোয়ারা তার নাম।
যেন সিনেমার পর্দায় আমি
চম্পাকে দেখলাম।
তার দিকে চোখ রেখে আমি তার
বাবাকে তোয়াজ করি –
‘এত সুন্দর আপনার বাড়ি!
মরে যাই! মরি, মরি!’
বাবা বলে, ‘থামো, তুমি তো পথিক!
বাড়ির তুমি কী জান!’
বললাম, ‘আমি কবিতাই লিখি,
সুরে বসালে তা গানও।
আমার নখের নিচে যে ময়লা
কসম দিচ্ছি তার – ’
দেখলাম যেন মনটি নরোম
হয়ে এল এইবার।
‘মনে হয় তুমি ক্লান্ত ভীষণ –
ঠিক আছে এসো ঘরে।’
কিন্তু এ কথা বলতেই হয়
ধূর্তামি ছিল স্বরে।
‘বিছানাটি পাবে ঘুমোবার, তবে
এই শর্তেই শুধু –
বিছানাই পাবে, চেয়ে বসবে না
তামাকের সাথে দুদু।’
ইশারাটি খুব আবছা তো নয় –
সরে যায় মনোয়ারা।
‘সকালে উঠবে, গাইটি দোয়াবে –
বিছানার এই ভাড়া।’
শুয়ে পড়তে না পড়তেই ঘুম
ভেঙে এল দুই চোখে।
আমি কতকাল ঘুমোতে পারিনি
নিহত দিনের শোকে।
হঠাৎ কী হলো? ঘরে কেউ এল?
চেয়ে দেখি মনোয়ারা।
অমাবস্যার রজনীতে যেন
খসেপড়া এক তারা।
‘পথিক, তুমি কি গোসল করবে?
সারা গায়ে কী যে ধুলো!’
হেসে বললাম, ‘ধুলো বলছ কী!
বন্ধু যে ওইগুলো।’
‘ধুলো বুঝি হয় বন্ধু কখনো?’
মনোয়ারা হেসে ওঠে।
আমি তো চাঁদের উদয় দেখেছি
কতবার কত ঠোঁটে।
এ জীবন জানি অমাবস্যার
একটানা এক রাত।
কোনোদিন যদি দিন আসে তবে
হতে পারে সাক্ষাৎ।
বেদনার মতো লাল দানাগুলো
ফেটে ফেটে পড়ে যায়।
নিঃশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে আমি
ডুবে যাই বিছানায়।
ভোর হয়ে যায়। মনে পড়ে যায়
গাই দুইতে যে হবে!
বাবা বলে, ‘আরে, অদ্ভুত এ তো!
কথা কে রেখেছে কবে!’
নিশ্চয় এটি বদ্ধ পাগল!
ভাগ্যে খ্যাপেনি রাতে!
বললাম আমি, ‘এখনো অনেক
খবর রয়েছে হাতে।’
‘কী রকম শুনি?’ প্রশ্ন বাবার –
মুখখানা হাসি হাসি।
‘যেমন ধরুন – ফিদেল কাস্ত্রো
তাকে বড় ভালোবাসি।’
বলেই আমি তো বিদ্যুৎবেগে
সরে যাই, দেখি বাবা
কাস্ত্রোর নাম হতে না হতেই
তুলছে বিশাল থাবা।
থাবা মানে থাবা! বাঘের সে থাবা!
সরে গেছি এক পাশে।
নেমে আসে থাবা, ভাঙে আলমারি,
মনোয়ারা খুব হাসে।
‘হারামির হাড়! পথিক সেজেছ!
কমুনিস্ট তুমি শালা।
পৈতৃক প্রাণ খোয়াতে না হলে
ব্যাটা এক্ষুনি পালা।’
পালা মানে পালা! চোখের পলকে
হাজার মিটার পার।
দৌড়বাজিতে আমার চেয়ে কে
বাহাদুর খেলোয়াড়!
বহুদূর থেকে ভাঙচুর শুনি –
ভাঙে জানালার কাচ।
মড়মড় করে ভেঙে পড়ে যায়
খামারবাড়ির গাছ।
মনোয়ারা ডাকে চিৎকার করে –
‘ফিরে এসো, উন্মাদ।’
অমাবস্যার দীর্ঘ রজনী।
ফিরবে যে কবে চাঁদ?
আমি ফিরব না এইটুকু জানি
মাড়াব না ওই পাড়া।
গার্মেন্টসের চাকরিতে আছে
আজকাল মনোয়ারা।
এখনো বাবার থাবাটি শক্ত,
রামদায়ে বড় ধার।
ধড় থেকে মাথা আলাদা করবে
দেখা পেলে একবার।
লোকে বলে তাকে – ‘রাগ হবে সে তো
আমাদেরও রাগ হয়।
দাড়ি থাকলেও ফিদেল কাস্ত্রো
মুসলমান তো নয়!
তবে ওই কবি, ওই যে পথিক –
ওরা আরো ভয়ানক।
হাতে যে কলম দেখছ ওদের –
আসলে বাঘের নখ।’
এখনো সে আছে ভয়ানক রেগে
খামারবাড়িতে একা –
পৃথিবীতে কত খামারবাড়িতে
পাবে তুমি তার দ্যাখ্যা।
তোমাকে তাড়িয়ে পথে যে নামায়
কোটি কোটি হয় তারা।
তোমার জন্যে একটিই বাড়ি –
একটিই মনোয়ারা।
তোমার জন্যে একটিই চাওয়া –
কবিতা একটি এই :
কথা বলবার স্বাধীনতা, তার
কোনো বিকল্প নেই ॥