ঢাকা ডেস্ক: উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চেনা ঘূর্ণিঝড়গুলোর তূলনায় রোয়ানু’র শক্তি ছিল অনেক কম। ধাক্কাও দিয়েছে ছোট করে। কিন্তু এই ছোট ধাক্কায় ক্ষতিটা হয়ে গেছে অনেক বড়। মৌসুমের প্রথম এই ঘূর্ণিঝড় আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, বড় ধাক্কা সামলাতে উপকূল মোটেই প্রস্তুত নয়। আর এই দুর্যোগ সামাল দিতে অপ্রস্তুত উপকূলের বাসিন্দারা সারা বছরই থাকেন আতঙ্কে।
দিনটা ছিল ২০ মে, শুক্রবার। শ্রীলংকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু বাংলাদেশের উপকূলের দিকে এগোতে থাকে। তখন থেকেই আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের মুখে শুনেছি, এটা মাঝারি ধরণের ঘূর্ণিঝড়। সে কারণে খুব বড় বিপদের সম্ভাবনা নেই। সমুদ্র তীরের মানুষেরাও এ বিষয়ে বিশেষ কোনো প্রস্তুতি রাখেননি। তাছাড়া ঝুঁকির এলাকায় থাকা বাসিন্দাদের কিছুই করার নেই। তারা ভালো করেই জানেন, দুর্যোগ ধাক্কা দিলে তারা কোনোভাবেই ঠেকাতে পারবেন না। হয়তো যথাসময়ে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যেতে পারে। প্রস্তুতির বিষয়টি বারবার আলোচনায় এলেও প্রস্তুতির ক্ষেত্রেই থেকে যায় বড় ধরণের সমস্যা। এবারও সে সমস্যা ছিল। আর তাই ছোট ধাক্কায় বড় ক্ষতি হয়েছে।
রোয়ানু তান্ডবের পর প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির তালিকার দিকে চোখ ফেরালে দেখতে পাই, উপকূলীয় জেলা ভোলা, লক্ষ্ণীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারকে এই প্রলয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। গোটা উপকূলে মাছচাষিরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আর পূর্ব উপকূলের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় লবণ চাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঝড়ে লাখের বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর প্রাথমিক হিসাবে জানতে পেরেছে, ৮০ হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি বা আংশিক ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রামে ৮০ কিলোমিটার এবং কক্সবাজারে ২৮ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ ভেঙেছে আরও অনেক স্থানে। বিধ্বস্ত স্থান দিয়ে জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢুকে ডুবে যায় বাড়িঘর। আর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় জরুরি বরাদ্দ হিসাবে পাঠানো হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিকটন চাল আর ৮০ লাখ টাকা।
ক্ষয়ক্ষতির তূলনায় বরাদ্দটা যে একেবারেই অপ্রতূল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাথমিক হিসাবে পাওয়া ক্ষতির তালিকার ৮০ হাজার পরিবারের মাঝে ৩ হাজার ৫০০ টাকা আর ৮০ লাখ টাকা সমানভাবে বন্টন করলে মাথাপিছু কত করে পড়বে, তা হিসাবের যন্ত্রটা টিপলে সহজেই বোঝা যাবে। রোয়ানু ক্ষতির পর মাঠ পর্যায়ে সহযোগিতা পৌছায় একেবারেই কম। আর এই সহযোগিতা বন্টন নিয়েও রয়েছে নানান ধরণের গল্প। যদিও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রিয়াজ আহমদ জানিয়েছেন ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তথ্যের ভিত্তিতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।ঘূর্ণিঝড়ের পর সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে বরাবরই বহুমূখী প্রশ্ন ওঠে।বরাদ্দ ঠিকই দেয়া হয়, কিন্তু তা যথাযথভাবে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে পৌঁছায় না। তালিকায় ভুল-ত্রুটি যেমন থাকে, তেমনি দলীয়করণের অভিযোগ তো সবসময়ই থাকে।
এবারের এই ঘূর্ণিঝড়ের পর বড় প্রশ্নটি এসেছে বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার নিয়ে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েকশ’গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। রোয়ানু চলে যাওয়ার দু’দিন পরেও বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর আসে বহু বাড়িঘর পানির নিচে। পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে চোখে পড়ে নাজুক বেড়িবাঁধ। এই বাঁধ সংস্কার ও মেরামতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকে না। আর একবার বাঁধ ভেঙে
যাওয়ার পর নতুন করে বাঁধ নির্মাণে তো বছরের পর বছর লেগে যায়। এখানে দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরতে পারি, কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের কথা। ২০১২ সালে সেখানকার গুরুত্বপূর্ন বেড়িবাঁধটি ভেঙে যাওয়ার পর আর জোড়া লাগেনি। কত মানুষ যে দ্বীপ থেকে অন্যত্র চলে গেছে, তার হিসেব নেই। এবার রোয়ানুর প্রভাবে এই দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ঘোলাপাড়া নামের একটি বসতি এলাকা।
কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামতের দাবি উঠেছে বহুদিন থেকে। সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় রয়েছে বায়ু বিদ্যুত কেন্দ্র। ওই ইউনিয়নটি কুদিয়ারটেক, তাবালার চর এলাকা থেকে বহু মানুষকে অন্যত্র যেতে দেখেছি। এইসব এলাকার বহু মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয় কক্সবাজারের সমিতি পাড়া নামক স্থানে কুতুবদিয়া পাড়ায়। মানে কুতুবদিয়া থেকে এত বেশি পরিমাণে লোকজন এখানে এসেছেন, পাড়ার নামটাই হয়েছে কুতুবদিয়া পাড়া। ঠিক পাশের উপজেলা মহেশখালীর ধলঘাটার দিকে চোখ ফেরালে দেখি আরেক বিপন্নতার চিত্র। রোয়ানু যখন এই এলাকা অতিক্রম করছিল, তখন স্থানীয় বাসিন্দা সাঈদ হোসেন আমাকে মুঠোফোনে জানালেন গোটা এলাকা পানিতে ডুবে থাকার অবস্থাটা। বিভিন্ন সময়ে ধলঘাটা ও মাতারবাড়িসহ আশপাশের এলাকা ঘুরে বিপন্নতার চিত্র দেখতে পাই। রোয়ানু’র ছোট ধাক্কাটাও যে ওইসব এলাকার মানুষের জন্য সহনশীল নয়, সেটা বোঝাই যায়।
পশ্চিম উপকূলের শরণখোলায় চোখ রাখি। এখানে ২০০৭ সালে আঘাত করেছিল প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর। এলাকার মানুষকে একেবারেই নিঃস্ব করে দিয়েছিল এই প্রলয়। বিভিন্নভাবে এলাকার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বছর দু’য়েক হলো এলাকার মানুষেরা জানতে পেরেছেন, অনেক বড় এবং উঁচু বাঁধ হবে। সেই আশায় বুক বাঁধছেন তারা। মাত্র মাসখানেক আগে সেই শরণখোলার দক্ষিণে তাফালবাড়িয়া গ্রামের পুরানো লঞ্চঘাট নামক স্থানে বেড়িবাঁধের পাশে দেখে এসেছিলাম ইউসুফ মৃধার ছোট্ট বসতি। তার প্রত্যাশা ছিল উঁচু বাঁধ হলে আবার নিরাপত্তা ফিরবে। কিন্তু ফিরলো না। তার আগেই শেষ হয়ে গেল সব।
লক্ষ্ণীপুরের রামগতি-কমলনগরের দিকে তাকালে দেখি বাঁধ নির্মাণের বরাদ্দে কাজ ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি। দুটো এলাকাই ভাঙছে। অথচ কাজ হচ্ছে একদিকে। এলাকার মানুষ এত কান্নাকাটি করলো, একসঙ্গে দু’দিক থেকে কাজ শুরু করুন। কে শুনে কার কথা? ফলে যা হবার তাই হলো। বরাদ্দ থাকা পরও কমলনগরের লুধুয়া, মতিরহাট, সাহেবেরহাট, জগবন্ধু এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছালো না সুবিধা। ফলে রোয়ানু’র ছোট ধাক্কাটাও এইসব এলাকার মানুষের সইবার ক্ষমতা ছিল না।
প্রাথমিক তথ্যচিত্র বলছে, নাজুক বেড়িবাঁধের কারণেই রোয়ানু’র ছোট্ট ধাক্কাটা এতবড় ক্ষতি করে গেছে। পরিচিত অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে রোয়ানু ততটা শক্তিশালী না হলেও ক্ষয়ক্ষতির তালিকা অনেক দীর্ঘ হচ্ছে। এবং এই ধাক্কাটা সামলে ওঠাটা উপকূলের মানুষের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে চারফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসও বেড়িবাঁধ সহনশীল হয়নি। তাহলে এর চেয়ে বড় উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস এলে তো সে দুর্যোগ মোকাবেলা করা মোটেই সম্ভব নয়। উপকূলের বেড়িবাঁধগুলো কেন এতটা নাজুক, এই প্রশ্নটি সংবাদমাধ্যম তুলে এনেছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সামনে। তিনি বলেছেন, রোয়ানু’র ধাক্কার সময় পূর্ণিমার জো থাকায় জোয়ারের চাপ বেশি ছিল। সে কারণে বাঁধ ভেঙেছে। জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ মেরামতের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে বলা হয়েছে।
ঝড় চলে গেছে, রেখে গেছে ধ্বংসের চিহ্ন। মানুষগুলো নিজেদের আবার গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত। যার চাষের মাছ চলে গেছে, সে তো একেবারেই নিঃস্ব। যার মাঠের লবণ চলে গেল, তার আর কিছুই নেই। যার ঘরখানা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হলো, সে তো পথেই বসে গেল। আবার ধারদেনা করে চলতে হবে। আবার কঠোর পরিশ্রমে গড়ে উঠবে নতুন জীবন। কিন্তু এই মানুষেরা বিপদে কাউকে কাছে পায় না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অন্য সবকিছুই না হয় বাদ দিলাম, এই যে শক্ত বেড়িবাঁধের দাবি, এর প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ কর্তৃপক্ষের আছে বলে মনে হয় না। উপকূলের মানুষেরা বাঁচতে চান। আর সেজন্য শক্ত বেড়িবাঁধের দাবিটাই তাদের কাছে বড় হয়ে আসে বারবার।
রফিকুল ইসলাম মন্টু
উপকূল-সন্ধানী সংবাদকর্মী।
তথ্যসূত্র: লেখাটি অনলাইন থেকে সংগ্রহীত