এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে মানুষ ও অন্যান্য জীব জানোয়ার আদি কাল থেকে সময়ের অতিথি হয়ে আসছে। আসছে শিশু হয়ে, মরছে বৃদ্ধ হয়ে অথবা প্রকৃতির দুর্বিপাকে পড়ে সময়ে অসময়ে। এই আসা-যাওয়া, জন্ম-মৃত্যু, তার কোন সঠিক সংজ্ঞা কারো জানা নেই। বিজ্ঞানের ফর্মূলায় মানুষ জীব জানোয়ারের জন্ম প্রকৃতি থেকে এবং মৃত্যুর পরে এই প্রকৃতিতেই তারা মিশে যাব। এমন অবস্থা আদি কাল থেকে শতাব্দির পর শতাব্দি চলছে এবং চলতে থাকবে। পৃথিবীতে আমাদের জীবন অল্প সময়ের জন্য। সময়ের স্রোতে ভেসে এসে কিছু দূরে গিয়ে আমরা নব-প্রজন্মের দৃষ্টির আড়ালে চলে যাব। পৃথিবীতে কম লোকই একশত বৎসর বেঁচে থাকে। তবে বিজ্ঞানীরা বলেন যে মানুষের হায়াত একশত বৎসর পর্যন্ত। কিন্তু একশত বৎসরে অনেক মানুষের আশা প্রত্যাশা পূর্ণ হয় না। অপূর্ণ স্বপ্নগুলী তাদের কল্পনার আকাশে মিশে যায়। মানুষের সব স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। প্রকৃতির নির্মম নিয়ম। সময়ের স্রোতে কিছু দূর ভেসে গিয়ে মরে যেতে হয়। জন্মের পরে – যা না কি অতীব সত্য হয়ে বাস্তবে আবির্ভূত হবে, তা হল মৃত্যু। এই মৃত্যুকে সত্য জেনেও মানুষ সুখের স্বপ্ন দেখে। আশা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন, সুখের স্বপ্ন।
ডাঃ ইছোয়ে তার অন্তরে ভবিষ্যতের কী ধরণের স্বপ্ন-চিত্র এঁকেছিলেন জানি না। ব্রাজিলের ছত্রিশ বৎসর বয়সের বিধবাকে বিয়েকরে সুদূর ব্রাজিল চলে যাওয়ার চার বৎসর পর হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় তিনি আমার বাসাতে এসে হাজির হলেন। তাকে বিগত চার বৎসর দেখি নি। বলতে গেলে তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ শরতের এই সন্ধ্যায় তাকে আমার দরজার সামনে দেখে বিস্মিত হলাম। ডাঃ ইছোয়ে আবার জাপানে ফিরে এসেছেন। পরিবর্তনের পূর্বেই পরিবর্তিত হওয়া উত্তম। তাহলেই মানুষের ধ্যানধারণাতে পরিপূর্ণতা আসে। পথের পিচ্ছিল স্থানে পা ফেলে পিছ্লে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না।
ইছোয়ের সঙ্গে বড় একটি স্যুটকেস আর কাঁধে একটি ব্যাগ। তার স্ত্রী সঙ্গে এসেছেন কি না তা বোঝার জন্য অতি আগ্রহে তার পিছনে তাকালাম। কিন্তু সঙ্গে তার কেউ আসেন নি।
বললাম, আপনার স্ত্রী আসেন নি?
ডাঃ ইছোয়ে জবাব দিল, ‘না, আসে নি!’
এই সময়ে আমার স্ত্রী এসে পাশে দাঁড়াল। আমি ইছোয়েকে ঘরে এসে বসতে বললাম। ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে সোফায় বসলেন। তার সামনে চায়ের কাপ রেখে আমার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, ‘সঙ্গে বউ নেই কেন?’
“তালাক দিয়ে এসেছি!”
‘তালাক? চার বৎসর ব্রাজিলে রইলেন, তালাক দিলেন কেনো, কোন সমস্যা হয়েছিল কি?’
“না, তেমন কোন সমস্যা হয়নি। সে দেশে থাকতে আর ভাল লাগল না, তাই তালাক দিয়ে ফিরে এলাম!”
জানতে চাইলাম, ‘সমস্যার উদ্ভব যদি না হয়, তালাক দিবেন কেন? একথা মেনে নিতে পারছি না ডাঃ ইছোয়ে!’
ইতিমধ্যে ডিনারের সময় হয়েছে। ইছোয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বসে বললেন, “ আসলে সত্য কথাই বলেছি। আমার ব্রাজিল থাকতে মন চাইছিল না। তার মা বাবার সাথেই ছিলাম। তেমন কোন সমস্যা হয়নি!”
তার মা বাবা কেমন লোক ছিলেন? জিজ্ঞাসা করলাম।
বেশ ভাল লোক। আমিও তাদের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিলাম!”
বললাম, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। বিয়ে করে চার বৎসর সংসার-ধর্ম করলেন। তারপর কোন কারণ ছাড়াই তালাক দিয়ে চলে এলেন। একথা মেনে নিতে পারছি না’।
ব্রাজিলে ডাঃ ইছোয়ে ত্রিশ লক্ষ টাকা দিয়ে একটি বাড়ি কিনেছিলেন। সে বাড়িতে দু’বৎসর ছিলেন। সে দেশে জাপানের ডাক্তারের কোন মূল্য নেই।ডাক্তারি প্র্যাকটিস করা নিষেধ। অগত্যা তিনি একটি ম্যাসাজ সেন্টার ওপেন করলেন। সেখানে বয়স্ক এবং কম বয়ষ্ক নারীপুরুষ ‘দেহ মর্দন’ (ম্যাসাজ) করাতে যায়। তা থেকে ইছোয়ের যা উপার্জন করে তাতে সংসার খরচের টাকা আসে। কোন সমস্যার উদ্ভব হয় নি। ডাক্তারগণ ম্যাসাজের উপর ভাল ধারণা রাখেন। তাই ব্রাজিল সরকার তাকে ম্যাসাজ পার্লার খোলার অনুমতি দিয়েছে।
ডাঃ ইছোয়ের সেন্টারে রোগীর সঙ্খ্যা দিনে দিনে বাড়তে লাগল। বিশেষ করে যারা গেঁটেবাতের রোগী ও বার্ধক্যজনিত কারণে দেহের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা বেদনাতে কষ্ট পাচ্ছেন – তারা দেহমর্দন করাতে যায়। দেহমর্দন কম বয়সী নারী-পুরুষও করাতে যায়। তাতে দেহে রক্ত সঞ্চালন ঠিক মতো সঞ্চালিত হয় বলে নারী দেহ বৈশিষ্ঠ সুন্দর হয়। ডাঃ ইছোয়ের ব্যবসা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল – তখন একদিন তিনি ম্যাসাজ পার্লারটি বন্ধ করে দিলেন। তারপর বাড়িটি বিক্রয় করে দিলেন ক্রয় মূল্যের প্রায় অর্ধেক দামে। তালাকের পর যা না কি করণীয় সবই করলেন।
“এখন বলেন কী কারণে তালাক হল?” আবার প্রশ্ন করলাম।
এবার ইছোয়ে ঘুরে বসলেন। তারপর বললেন, “আমার শ্বশুর একদিন আমাকে বলেছিলেন, “তুমি তো বেশ ‘ভোজনবিলাস’, অনেক খেতে পার!”
ইছোয়ে মৃদু হেসে জবাবে বললেন, “ কথাটি যদিও হাস্যকর। একথায় রেগে যাওয়ার কথাও নয়। তবু কেন জানি আমার মনে অন্যরকম এক রাগ এসে বাঁধা বাঁধল। কারণ, খাওয়ার সময় এমন কথা শ্বশুরের মুখ থেকে শুনবো ভাবতে পারিনি। তাই রেগে গেলাম। কিন্তু তাকে একথা কিছুই বুঝতে দেই নি। আমি স্ত্রীকে একদিন বলে বুঝালাম যে আমার প্রতি তোমার বাবার শ্রদ্ধাবোধ থাকলে এমন কথা কিছুতেই বলতে পারতেন না। তার মনে যদি এই থাকে। তাহলে আমি আর ব্রাজিল থাকবো না। তোমাকে আমি তালাক দিয়ে দেশে ফিরে যেতে চাই!”
বললাম, “হঠাৎ একথা শুনে আপনার স্ত্রী বিব্রত বোধ করেন নি?”
বললেন, “না, তেমন বিব্রত হয় নি। সে কিছুক্ষণ ভেবে তালাকের ব্যাপারে সায় দিল। আমিও দ্রুত কাজ সেরে নিলাম!”
বললাম, “থাক, থাক, আর বেশি কিছু শুনতে চাই না। এখন বলেন ব্রাজিলের লোকজন কেমন, তারা বিদেশীদের প্রতি বন্ধু বৎসল কি না!”
ব্রাজিলের লোকজনদের জাপানীরা সবাই ভাল জানে এবং মূল্যায়নও করে। জাপানে অনেক ব্রাজিলের শ্রমিক আছে। তাদের সুবিধার জন্য রেল ষ্টেশন ও পাবলিক অফিসগুলিতে জাপানী ভাষার পাশাপাশি পর্তুগিজ ভাষাতে গাইড লাইন, ইত্যাদি, লেখা থাকে। কোরিয়ান ভাষাতেও লেখা থাকে। এই বদান্যতা বিভিন্ন স্থানে দেখে অবাক হয়েছিলাম। এক সময়ে জাপানীরা চাইনীজদের তুচ্ছজ্ঞান করতো। নব্বইয়ের দশকে যখন অবৈধভাবে বিদেশী শ্রমিকেরা কাজ করতো তখন জাপানকে আমেরিকার পর বিশ্বের দ্বিতীয় ‘বৃহত্তম ইকোনমি’ বা ধনী দেশ হিসাবে গণ্য করা হত। তখন অনেক চাইনীজ শ্রমিক এসে রেষ্টুরেন্ট এবং ফ্যাকটোরিগুলিতে কাজ করতো। সে সময়ে জাপান সরকার অবৈধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। পুলিশ ও অভিবাসন সংস্থার লোকেরা যৌথ অভিযান চালিয়ে অবৈধ শ্রমিকদের ধরে তাদের গ্রেফতার করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশে পাঠিয়ে দিতো। অবৈধ শ্রমিকদের ধরার কলা-কৌশল ভিডিও করে টিভি ও বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করত। তখন জাপানে মনে হয় মানবাবিধার সংস্থার উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা ছিল না। মানবাধিকার সংস্থার দপ্তর থাকলেও তাদের সক্রিয় কোন ভূমিকা ছিল না। তখন প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি জাপান
সরকারের বৈমাত্রিয়সুলভ আচরণ দেখে অবাক হয়েছিলাম। তাই ডাঃ ইছোয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম ব্রাজিলের জনসাধারণ প্রবাসীদের প্রতি বন্ধুবৎসল কি না জানতে।
ইছোয়ে উত্তরে বললেন যে ব্রাজিলের লোক বন্ধুবৎসল। সে দেশে এতোদিন থেকে নিজেকে প্রবাসী মনে হয়নি। বহুজাতীর সংমিশ্রণে আজকের মডার্ন ব্রাজিল। দেশটিতে সবকিছুই সহজলভ্য। উপার্জন না থাকলে এবং কাজ না করলেও ব্রাজিলে কেউ উপোষ করে না। গাছগাছালিতে প্রচুর ফল। গাছের মালিককে জিজ্ঞাসা না করে ফল পেরে খেলেও কেউ বাধা দেয় না। এক কথায় দেশটির সর্বত্র প্রাচুর্য রয়েছে।
ইছোয়ের কথা শেষ হওয়ার পর ভাবলাম কেন তবে ব্রাজিলের লোক এখন জাপানে কাজ করতে আসে। জিজ্ঞাসা করার পর বললেন, “খাদ্যাভাব না থাকলেও মানুষের অনেক চাওয়া পাওয়ার ব্যাপার আছে। তা হলো ক্যাশ টাকা। কর্মক্ষেত্রের ঘাটতি রয়েছে। কাজ করলে ক্যাশ টাকা পায় এবং হাতে টাকা থাকলে ইচ্ছামতো পছন্দের কিছু কিনতে পারে। বাড়ি গাড়ি সুন্দরী স্ত্রী যৌবনে সবার কাম্য। কিন্তু ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্স না থাকলে কারো স্বপ্ন পূরণ হয় না! তাই অনেক যুবক যুবতি ভাগ্যান্বেষণে জাপানে কাজ করতে এসে কিছু ক্যাস পয়সা অর্জন করে ফিরে যায়। ”
জানতে চাইলাম, “ভালবেসে বিয়ে করেছেন। আপনার স্ত্রীর তো কোন ত্রুটি ছিলনা। কেমনে তালাক দিলেন। তালাক দিতে চাইলেই কি তালাক দেওয়া যায়। অন্তর্দহন বলতে একটি কথা আছে না?”
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইছোয়ে গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ তিনি চুপ করে রইলেন। মনে হল আমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
সবার জীবনে পরিবর্তন আসে। জীবনের এলোমেলো পথে চলতে গিয়ে স্থানে স্থানে আছাড় খেয়ে পরিবর্তন হওয়া বড় দুঃখজনক। আমার মনে হল ইছোয়ের জীবনের পূর্ণাংগ পরিবর্তন আসেনি। তার ধ্যানধারণা তেমন পোক্ত নয়। শিশুসুলভ মন তার। তখন ককো শ্যানেল এর মূল্যবান উক্তিটি মনে পড়ল, “ আমার জীবন আনন্দের ছিল না, আমি আমার জীবন নিজেই গড়েছি!” হ্যাঁ, যারা সাবধানে তাদের জীবন পরিকল্পনা করে গড়ে নেয় – তাদের এমন অবস্থার সম্মূখীন হতে হয় না।
মনের ভিতরে প্রশ্ন জাগল, তাহলে ডাঃ ইছোয়ে জীবন গড়ার জন্য এখন কোন পথে যেতে চান। জীবন গড়ার কেমন স্বপ্ন তিনি দেখছেন।
যখন একথা ভাবছিলাম, “ ইছোয়ে বললেন, আমি আপনার বাসাতে সাত দিন থাকতে চাই, আপনাদের অসুবিধা হবে না তো?” ( চলবে )
ডঃ আরশাদ উল্লাহ
জাপান প্রবাসী গবেষক লেখক ও কবি