নিশিদা সান তার দ্বিতীয় পুত্রের নিকট শুঁড়িখানাটির ভাড়া বাবদ মাসপ্রতি সত্তর হাজার টাকা দিতে যখন বললেন। সে সময় পুত্রটির গার্ল ফ্রেন্ড পাশেই বসা ছিল। দুজনে বিয়ের কথা বলার পর নিশিদা খুশি হয়ে তাদের স্বাগত জানাবেন মনে করেছিল। কিন্তু তিনি তা না করে পুত্রের নিকট দোকানের ভাড়া দিতে বললেন। পুত্রটি বিস্মিত হয়ে বলেছিল, “বাবা, তোমার কি টাকার অভাব আছে? তুমি আমার নিকট দোকানের ভাড়া চাও?”
ছেলের গার্ল ফ্রেন্ডটি সেদিন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিল, “তোমার বাবা খুশি হবেন ভেবেছিলাম। আমাদের ব্যাপারে তো কিছুই মন্তব্য করলেন না। তিনি বরং ভিন্ন প্রসঙ্গ এনে দোকানের ভাড়া চাইলেন। তোমার বাবার কথাগুলি আমার পছন্দ হয় নি!”
ছেলেটি প্রবোধ দিয়ে বলেছিল, “দেখা যাক কি হয়। হয়তো আমাকে যাচাই করার জন্য বলেছেন। মনে মনে পুত্রটি তার পিতার প্রতি ক্ষুব্ধ হলেও সে তার গার্ল ফ্রেন্ডকে শান্তনা দিয়ে বলল, “সে যাই হোক, আমি আমার বারটি চালিয়ে যাব।”
তারপর কয়েক মাস বারটি চালাবার পর নিশিদা যখন ভাড়ার টাকা পেলেন না, তিনি পুত্রের অগোচরে রিয়াল এস্টেট কোম্পানির নিকট জমিন সহ বারটি বিক্রয় করে দিলেন। এই কথা শুনে লজ্জায় অপমানে তার দ্বিতীয় পুত্রটি এক রাতে তার নিজের কামরায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করল।”
সাতো সানকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “ছেলের অপমৃত্যুতে নিশিদা সানের প্রতিক্রিয়া কি ছিল। তোমার নিকট বা অন্য কারো নিকট কোন প্রকার মন্তব্য করেছিলেন কি?”
সাতো আমার প্রশ্ন শুনে হাসল। বলল, “তার মতো পাষাণ ব্যক্তি সন্তানের মৃত্যুতে বিন্দু মাত্র অনুশোচনা করে নি। প্রতিবেশির সাথে এই ব্যাপারে পরীষ্কার কোন ব্যাখ্যাও দেয় নি। তবে তার কিছু প্রতিবেশি সম্পর্ক চ্ছেদ করেছে। দুঃখের ব্যাপার হল এসব কারণে বড় অস্বস্তিতে পড়লেন নিশিদার স্ত্রী। ছেলেটি আত্মহত্যা করার পর তিনি প্রতিবেশীদের সাথে তেমন দেখা সাক্ষাত করেন না। তুমি কি তার স্ত্রীকে দেখেছ?”
“না, দেখি নি।”
“তিনি লজ্জায় কারো সাথে কথা বলেন না। তুমি নিশিদার ঘরে গেলেও তার স্ত্রী সামনে আসবেন না।”
বললাম, “ছেলের আত্মহত্যার কারণে না কি?
সাতো সান গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। দু’টি প্রসংগ একত্রে মিলিয়ে বলতে তার এলোমেলো হয়ে যায়। সে তার প্যান্টের দুটি পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, “একটা কথা মনে রাখবে, আমি এমন একজন লোক – মানুষের বদনাম করা পছন্দ করি না। গাড়ি বিক্রি তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। তার কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। শুধু পঞ্চাশ সি সি অটো বাইকের একটি লাইসেন্স আছে। গাড়ি কিনেছে সে – বিনা বেতনে আমাকে দিয়ে ড্রাইভ করার জন্য। মানুষকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে পারিশ্রমিক দেয় না। কারো সন্তান বা কোন লোক ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করাকে জাপানী সমাজে লজ্জার ব্যাপার মনে করে। আমি তো একা মানুষ, কোন প্রকারে চলি। সমাজ আমাকে মূল্যায়ন করে না। আমার সমাজ না থাকলেও চলে। একা মানুষ আমি। কিন্তু নিশিদার সমাজ আছে। সে ধনী ব্যক্তি এবং এই শহরের আদি বাসিন্দা, তাকে সবাই চিনে। কিন্তু যখন পিতার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে সন্তান আত্মহত্যা করে – জাপানের সমাজ সেটা সহজ ভাবে নেয় না। এমন কিছু হলে প্রতিবেশিরা সে বাড়ির লোকগুলির স্বভাব-চরিত্র নিয়ে নিন্দা করে এবং সম্পর্ক চ্ছেদ করে। তবে নিশিদাকে কেউ সমাজচ্যুত করতে পারবে না। কিন্তু আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি, তার সমাজে যারা আছে তারা মুখে কিছু না বললেও অন্তর থেকে তাকে ত্যাগ করেছে। গভীর ভাবে বিবেচনা না করেই সমাজের একটি লোক তার নিত্যদিনের জীবন যাপন থেকে বুঝতে পারে যে সমাজের মানুষগুলি একে অপরের জন্য বিদ্যমান আছে। তারা একে অন্যের উপর পরোক্ষ ভাবে নির্ভরশীল । কিন্তু নিশিদার ক্ষেত্রে সেকথা প্রযোজ্য নয়। সে মনে করে যে তার টাকা আছে, সমাজের প্রয়োজন নেই। সে একাই সমাজে টিকে থাকতে পারবে।”
এই পর্যন্ত বলে সাতো সান থামল। সে তার পকেটে কি যেন খুঁজতেছে।সে সিগারেট খায়। সম্ভবত সিগারেট খুঁজতেছে। সাতো যে ব্রান্ডের সিগারেট খায় তার নাম “HOPE”। সরকার ট্যাক্স বাড়িয়ে দেয়াতে সিগারেটের দাম আড়াইগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু সাতো সিগারেট খাওয়া ছাড়তে পারে না। আমাকে বলেছে যে মাঝেমাঝে তার হার্টে কাঁপুনি হয়।কিন্তু এই ‘হোপ’ ব্রান্ড সিগারেটে সাতো যে তার জীবনের কি ‘হোপ’ খুঁজে তা জানি না।
তাকে বলেছি, “সিগারেট ছাড়, বুকের কাঁপুনি চলে যাবে।”
জবাব দিয়েছে, “নাহ্, সিগারেট ছেড়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।আমার তো কিছুই নেই, স্বার্থপর হয়ে পৃথিবীতে কাপুরুষের মতো বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। যেদিন আমার মৃত্যু আসবে – সেদিন তাকে স্বাগত জানাব!”
বললাম, “তোমার কুকুর দু’টির কি হবে?”
আমার প্রশ্ন শুনে হাসল সাতো সান। বলল, “এতো তাড়াতাড়ি মরব না। কুকুরগুলির জন্য বেঁচে থাকতে চাই কিছুদিন। তাদের আমি যত্ন করি। সেগুলি আশির্বাদ করে, আমি বুঝতে পারি যে পশুর আশীর্বাদও প্রভু বিবেচনা করেন। আশা করি যে তাদের আশীর্বাদে আরো কিছুদিন বা কিছু বছর প্রভু আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। আমার এই দু’টি কুকুর ছাড়া আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। জীবনে বহুবার অনেকের নিকট প্রতারিত হয়েছি। আমার পৃথিবীতে এই কুকুর দুটি ছাড়া বিশ্বস্ত অন্য কেউ নেই। স্ত্রী থাকলে দাম্পত্য কলহ হতো। এখন আমি সেই কলহ যন্ত্রণা থেকেও মুক্ত।”
আমরা দুজন লাঞ্চের পর রেষ্টুরেন্টে বসে কথা বলছি। কফির অর্ডার দিয়েছিলাম, একটি সুন্দরী যুবতি ওয়েট্রেস দু’কাপ কফি এনে টেবিলে রেখে গেল। সাতো ‘আইস কফি’ পছন্দ করে। সে এক ঢুক পান করে সিগারেটে আগুন দিল।
আমাকে বলল, “তোমার তো নিশিদা সানের বাড়িতে যাওয়া আসা আছে। সে বাড়িটিতে ভূতের বাড়ির মতো অদ্ভূত একটি শুন্যতা রয়েছে, তা কি অনুভব করেছ?”
বললাম, “এতো কিছু তো জানতাম না। জানলে হয়তো অনুভব করতাম। কিন্তু কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ করেছি। বড় ছেলেটির গাড়ি আছে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ইচ্ছা মতো সেঘুরতে পারে।”
সাতো আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “রাখো সে ছেলের কথা। ছেলেকে বললেও সে কিছুতেই যাবে না। বড় ছেলের সাথেও নিশিদার সম্পর্ক খারাপ।”
“কিছুতেই যাবে না? এমন জটিল কোন কিছু পিতা পুত্রের সম্পর্কে থাকতে পারে কল্পনাও করতে পারি না।”
এই কথা শুনে সেদিন সত্যই আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম। বড় ছেলের সাথেও নিশিদার সম্পর্ক খারাপ। তা কেন হবে? নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম। এই পর্যন্ত তিন কি চারবার ঘরের সামনের উঠানে নিশিদার বড় ছেলেটিকে দেখেছি। সে সময় নিশিদা উঠোনে ছিল। কিন্তু পিতাপুত্রের মধ্যে কোন বাক বিনিময় হয় নি। পুত্রটি আমার পরিচয়ও জানতে চায় নি। সাতো ও আমার স্ত্রী বলেছে নিশিদার স্ত্রী আছে। বিভিন্ন কাজে নিশিদার ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে সোফায় বসে সবুজ চা খেয়ে কথা বলেছি। কিন্তু তার স্ত্রীকে একবারও দেখি নি। এটাও এক বিস্ময়। জাপানের প্রথামতে ঘরে অতিথি গেলে স্ত্রী এসে চা পরিবেষণ করেন। কিন্তু সেদিন নিশিদা নিজে চা বানিয়ে এনে টেবিলে রাখলেন এবং কিছুক্ষণ খোশ গল্প করলেন। ঘরে তার স্ত্রীকে এক পলকও দেখি নি। কারণ কি জানি না। এই পৃথিবীতে অনেক কিসিমের মানুষ আছে। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বুঝেছি যে সর্ব শ্রেণির মানুষের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে হয়। ধর্ম বর্ণ ভিন্ন হলেও, ভাষা সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও, সবাইকে সমান চোখে দেখতে হবে এবং ভালবাসাতে হবে। সবার সাথে সম্পর্ক রেখে সৌজন্য বজায় রাখতে হবে। তা না হলে সমাজে সম্পৃক্ততার সৃষ্টি হয় না। কিন্তু সবার উপর ষোল আনা আস্থা রাখা ঠিক হবে না। অতিরিক্ত আস্থা-ভাজন হলে কোন এক সময়ে অপ্রীতিকর সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। শেক্সপীয়ার বলেছেন, “A fool thinks himself to be wise, but a wiseman knows himself to be a fool.”
বড় অপ্রীয় বাক্য হলেও আমার মনে হয় একথাটি নিশিদা সানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তিনি যখন কথা বলেন তখন নিজেকে সর্বাধিক বিজ্ঞ মনে করেন। অন্য কারো ভাল কোন পরামর্শকে তিনি আমল দেন না। সাতো সান কফি খেয়ে ইতিমধ্যে দু’টি সিগারেট পুড়েছে। এখন চোখ বুঝে বসে আছে। তাকে যখন দেখি তখন জানতে ইচ্ছা হয় তার জীবনের উদ্দেশ্য কি হতে পারে। আবার একথাও ভাবি যে আমার মতোই একজন সাধারণ মানুষ সে। ব্যতিক্রম শুধু তার স্বাস্থ্য আমার চেয়ে অনেক ভাল। চিন্তা ভাবনাতে শুধু কিছুটা তফাত রয়েছে। এখনো যে পরিমাণ শ্রম দিয়ে সে উপার্জন করে, সে পরিমাণ শ্রম আমি দিতে পারি না।
হঠাৎ চোখ মেলে তৃতীয় সিগারেটে লাইটার দিয়ে আগুন দেয়ার আগেই তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “নিশিদার বড় ছেলের স্ত্রী নেই?”
বলল, “অবশ্যই আছে। তার দু’টি সন্তানও আছে। তারা সিনিয়ার হাই স্কুল পাশ করে চাকুরি করে মনে হয়। তবে তারা এই বাড়িতে থাকে না।”
“কেন থাকে না?” জানতে চাইলাম। কিন্তু সাতো আমার এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে শক্ত চোয়াল দেখিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
“কি হল সাতো সান, উত্তর দাও না কেন?” তাগাদা দিলাম।
আমাকে বিস্মিত করে সে জবাব দিল, “এই প্রশ্নের উত্তর যদি দেই – তখন তুমি মনে করবে যে আমি নিশিদার বদনাম করছি। আজ তোমার প্রশ্নের উত্তর দিবো না।”
“কেন?”
“আমাকে ভাবতে দাও।”
তারপর প্রসংগ পাল্টিয়ে সাতো বলল, “অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। বাসায় ফিরব। কবুতরগুলিকে আদার দিতে হবে।
মাস তিনেক পূর্বে সাতো নিজ হাতে কিছু কবুতরের খুপ্রি বানিয়েছে একটি জঙ্গলের নিকট। জমিটা তার নয়। তার সাথে একসময় কাজ করত অন্য একটি লোকের অনাবাদী জমি। জাপানে একটি প্রচলিত কথা আছে, তা হলো “দোইতো”। কথাটির ইংলিশ “ Do it yourself” থেকে হয়েছে। অর্থ “তুমি নিজে কর।”
এটি একটি চেইন ‘হোম সেন্টারে’র নাম। সারা জাপানে শত শত ব্রাঞ্চ আছে। সেখানে বিভিন্ন সাইজের কাঠ ফালিফালি করে রাখা, যন্ত্রপাতি,হাতুড়ি, স্ক্রু ড্রাইভার, করাত ইত্যাদি সব রাখা আছে। বাগান কিংবা সখের কিছু করতে হলে প্রয়োজনীয় জিনিষগুলি কিনে এনে নিজেই করা যায়।
সাতো দুই থাকে উচু করে কুড়িটি কাঠের খুপড়ি মজবুত করে বানিয়েছে। সে কারো সাহায্য নেয় নি। আমাকে একদিন ডেকে নিয়ে দেখিয়েছে।
জিজ্ঞাসা করেছি, “কবুতর পালবে কি জন্য, তুমি কি কবুতরের মাংস খাও?”
বলল, “না, খাই না। জাপানে কেউ কবুতর খায় না। কবুতর ভালোবাসি বলে পালি। নিয়মিত খাবার কিনে দেই।”
বললাম, “তুমি আরেকটি ঝামেলা বাড়ালে। সত্য করে বল তো সাতো সান, কবুতর কেন পালছো। মিশরীয়দের নিকট না কি কবুতরের মাংশের অনেক কদর। কোন মিশরীয় রেষ্টুরেন্টে কবুতর সাল্পাই দেওয়ার মতলব নয় তো?”
বলল, “বিশ্বাস করো এমন কাজ আমার দ্বারা সম্ভব না। আমি কবুতর ভালবাসি।”
সেদিন নিশিদার বড় ছেলের স্ত্রী ও সন্তানের ব্যাপারে আর কিছুই সে বলল না। জবাব দিয়েছে, ‘সে কথা অন্য দিন হবে!’
তখন শরত কাল। কয়েকদিন পর সকালে হাঁটতে যাওয়ার পথে সাতোকে তার বাসার নিকট মোটর সাইকেলের টায়ার বদলাতে দেখলাম। আমাকে দেখে বলল, “বাইকের টায়ার ক্ষয় হয়েছে, তাই ভাল দেখে পুরানো টায়ার কিনে এনেছি।। নতুন টায়ার অনেক বেশি দাম।”
আমি তার কথার প্রতিউত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম, “আজ চিচিবু সিটিতে যাব। শরত বায়ুতে ম্যাপল বৃক্ষের পাতাগুলি লাল বর্ণ ধারণ করেছে। পর্বত সারিতে মাইলের পর মাইল লালে লাল বর্ণে ছেয়ে গেছে। আমি ক্যামেরাতে ফটো নিব, যাবে তুমি?”
আজ আমার চিচিবু পার্বত্য নগরীতে যাওয়ার কোন প্লান ছিল না। সাতোকে কোন কিছুর লোভ না দেখালে যাবে না। চিচিবু নগরে যেতে প্রায় সত্তর কিলোমিটার পার্বতের আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে যেতে হয়। পর্বতের উপরে এই নগরটিতে শরৎকালে হাজার হাজার পর্যটক যায়। যাওয়ার সময় রাস্তার দু’ধারের প্রকৃতির নান্দনিক দৃশ্য দেখে তৃপ্তি পায়।। প্রতি বৎসর আমি কয়েকবার এই শহরে বেড়াতে যাই। তবে একা যাই না। কারণ পার্বত্য সরু রাস্তায় ড্রাইভ সাবধানে করতে হয়। সাতো ভাল ড্রাইভ করে। অর্ধেক পথে আমি এবং বাকি অর্ধেক পথে সে ড্রাইভ করবে। মেন্টাল স্ট্রেস কমাতে এই পথের দু’ধারের পর্বতের গাঢ় জঙ্গলের রূপ দেখতে ভাল লাগে। আমি জানি যে লাঞ্চ খাওয়ালে সে সাথে যাবে। তাই আমার প্রস্তাব সে লুফে নিল। বলল, “অবশ্যয়ই যাব। তুমি গিয়ে রেডি হও। আমি টায়ার সেট করে পনের মিনিট পরে যাব।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। দ্রুত হেঁটে বাসায় ফিরে এসে চিচিবু নগরীতে যেতে প্রস্তুতি নিলাম। আসল উদ্দেশ্য সাতো সানের কাছ থেকে নিশিদা সানের বড় ছেলের ব্যাপারে আজ জেনে নিব। সহজে সে গোপন কিছু বলতে চায় না। তাই হঠাৎ করেই তাকে দেখতে পেয়ে আজকের পরিকল্পনা করলাম।
চিচিবু নগরীর পথে যেতে যেতে অনেক কথা হল। নিশিদার ব্যাপারে আরও কিছু বিস্ময় বিস্ফুরিত হল। নিশিদার বড় ছেলের নাম আকিদা।
সে একটি বড় ফ্যাক্টরীতে কর্মরত ছিল। আকিদা এবং তার স্ত্রী সুখেই ছিল। বিশাল এই বাড়িটিতে শিশু দু’টির কন্ঠ বাড়িটিতে সর্বক্ষণ প্রাণের সঞ্চার করত। বড় ছেলেটির বয়স যখন পাঁচ এবং ছোট ছেলেটির বয়স তিন – তখন থেকে এই বাড়িটিতে অদ্ভূত ব্যাপার ঘটতে লাগল। যদি বলা হয় ভৌতিক ব্যাপার – তাহলে কমই বলা হবে। তার চেয়েও জঘন্য ব্যাপার-সেপার উদ্ভাসিত হল। সাতোর মতে বাড়িটিতে সব শয়তানের বড় শয়তান হল খোদ নিশিদা সান!
কর্মক্ষেত্রে নিশিদার বড় ছেলে আকিদার মাসে চারদিন নাইট ডিউটি থাকে। একদিন সে যখন নাইট ডিউটিতে নিশিদা রাতে তার সুন্দরী ছেলের বউকে বিছানায় ঝাপটে ধরল। প্রবল বাঁধার কাছে নিশিদা কিছুই করতে পারল না। বউটি হয়তো ভেবেছে যে নিশিদা এমন আর কোনদিন করবে না। কিন্তু আরেক দিন রাতে বউটিকে আক্রমণ করল নিশিদা। অনেক ধস্তাধস্তি হল। বউটি কোন প্রকারে নিজেকে রক্ষা করল। কিন্তু তৃতীয় চান্স দেওয়ার আগেই বউটি তার স্বামিকে সবকিছু খুলে বলল। আকিদা একথা শুনে প্রচন্ড রাগ করল। সে গিয়ে তার বাবাকে এই ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে বলল। কিন্তু নিশিদা কোন কিছু বলল না। অনুতাপও করল না। ক্ষমাও চাইল না।
অন্যদিকে আকিদার স্ত্রী বলল, “যত শীঘ্র সম্ভব অন্য কোথাও বাসা ভাড়া নাও। আমি এই বাড়িতে তোমার অনুপস্তিতে থাকতে পারবো না।”
বড় সমস্যায় পড়ল আকিদা। ছোট ভাইয়ের আত্মহত্যার পর বাবাকে সে ভাল দৃষ্টিতে দেখে না। খুব কম কথা বলে।
সাতোকে বললাম, “এতো বড় গোপন কথা। কার কাছ থেকে এসব শুনলে?”
“আকিদা বলেছে। সে যখন তার বউ বাচ্চা নিয়ে চলে যাচ্ছে। সেদিন তাদের মাল-সামানা ট্রাকে আমি তুলে দিয়েছি। তখন এক ফাঁকে আকিদা বলেছে।”
“কোথায় গেল তারা? জানতে চাইলাম।
বলল, তারা হিগাশিমাৎচুইয়ামা সিটিতে এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকতো। অনেক বছর বাড়িতে ফিরে নি। দীর্ঘ আট বৎসর পর মাঝে মধ্যে ছেলেটি বাড়িতে তার মায়ের অনুরোধে আসা যাওয়া করছে। আকিদার মায়ের শরীর ভাল না। বাতের রোগী, রান্না করতে কষ্ট হয়। তাই আকিদা এসে রান্না করে দিয়ে যায়। কিন্তু থাকে না।”
আমি বললাম, “আমাদের সাথে পরিচয় হওয়ার পর তো দেখছি ছেলেটি এই বাড়িতেই থাকে।”
“হ্যাঁ , এখন এক সাথেই থাকে।”
“আকিদার স্ত্রী ও সন্তানের নিকট যায় না?”
আমার এই প্রশ্ন শুনে সাতো সান দমে গেল। কিছুক্ষণ কথা বলল না।
আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “আকিদার সাথে কথা হয় না?”
“না, সে ব্যাপার একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। আমার মনেও এই প্রশ্ন ছিল। জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও ছেলেটির মুখের গম্ভীর ভাব দেখে জিজ্ঞাসা করার সাহস হারিয়ে ফেলেছি।”
আমি আবার বললাম, “তার দুটি সন্তান তাদের দাদীকে দেখতে আসে নি?”
“না, প্রায় দশ বৎসর যাবত এই বাড়িতে তারা আসে না।”
“বড় ছেলের বউয়ের সাথে তালাক হয়ে গেল না কি?”
“হ্যাঁ , তা হতে পারে। সম্ভবত তালাক হয়ে গেছে। তবে আমি সিউর নই। আকিদা গত তিন বৎসর যাবত একাধারে মায়ের সাথেই আছে।” একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সাতো সান বলল।