বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে জাপান তার ঔজ্জ্বল্য ক্রমে হারিয়ে ফেলছে। আগামী অর্থবছরে দেশটি মন্দায় নিমজ্জিত হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এর ওপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাহিদা কম থাকায় ডিসেম্বরে দেশটির রফতানি দুই বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ পতনের সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনীতির এ অবস্থায় বিনিয়োগ করতে আস্থা পাচ্ছেন না বেশির ভাগ ব্যবসায়ী। অন্যদিকে অর্থনীতি চাঙ্গা করতে নীতিনির্ধারকরা ২ শতাংশের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও তা অর্জন করতে পারছে না দেশটি। ফলে ব্যাংক অব জাপান (বিওজে) বুধবার মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস আরেক দফা কর্তন করেছে এবং অতিশিথিল মুদ্রানীতিমালা ধরে রেখেছে। খবর রয়টার্স ও এএফপি।
জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের (এমওএফ) বুধবার প্রকাশিত উপাত্তে দেখা গেছে, এক বছর আগের তুলনায় ডিসেম্বরে রফতানি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ কমে গেছে, যা ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর সর্বোচ্চ। যেখানে রয়টার্সের জরিপে অর্থনীতিবিদরা রফতানি ১ দশমিক ৯ শতাংশ কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। রফতানির এ তথ্য মূলত জাপানের ওপর বহির্বিশ্বের চাপ বৃদ্ধির বিষয়টিই প্রতিফলিত করছে।
চীনের শ্লথগতির কারণে জাপানের অর্থনীতি এরই মধ্যে চাপে রয়েছে, এর ওপর রফতানি কমে যাওয়ায় আসন্ন প্রান্তিকগুলোয় অর্থনীতি আরো কোণঠাসা হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চীনের সেমিকন্ডাক্টরস, মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্য সরবরাহকারী জাপান। চীনের অর্থনৈতিক শ্লথগতি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে এসব পণ্যের চাহিদা কমে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে জাপানের রফতানিতে। জাপানের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী দেশ চীনে ডিসেম্বরে রফতানি ৭ শতাংশ কমেছে। সর্বোপরি এশিয়ায় জাপানের রফতানি ৬ দশমিক ৯ শতাংশ কমে গেছে। অথচ দেশটির মোট রফতানির অর্ধেকের বেশি এ অঞ্চলে সম্পন্ন হয়।
তবে এক বছর আগের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ১ দশমিক ৬ শতাংশ রফতানি বেড়েছে জাপানের। এ সময় সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন যন্ত্রাংশ এবং গাড়ির মোটর রফতানি করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাপানের আমদানি বেড়েছে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। সার্বিকভাবে ডিসেম্বরে জাপানের আমদানি বার্ষিক হিসেবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে। এর সূত্র ধরে দেশটি ৫ হাজার ৫৩০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে।
ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের জাপান-বিষয়ক অর্থনীতিবিদ মার্সেল থিয়েলায়ান্ট বলেন, ‘নিট বাণিজ্য চতুর্থ প্রান্তিকের জিডিপিতে প্রভাব ফেলেছে। আমাদের ধারণা, চলতি বছরও তা দুর্বল অবস্থায় থাকবে।’
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ এরই মধ্যে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়লে জাপানসহ অন্যান্য দেশের করপোরেট মুনাফায় উল্লেখযোগ্য পতন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যার সূত্র ধরে শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলো তীব্র মন্দায় নিমজ্জিত হবে। চীনের শ্লথগতির কারণে ডিসেম্বরে তাইওয়ানের রফতানি কমেছে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রান্তিককালীন রফতানি কমেছে।
রয়টার্সের এক জরিপে দেখা গেছে, জাপানের এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি কোম্পানি আসন্ন অর্থবছরে মূলধন বিনিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আর বাদবাকিরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। চীন থেকে চাহিদা কমে যাওয়ায় কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা পূর্বাভাস কর্তন শুরু করেছে।
রয়টার্সের এক মতামত জরিপে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বহির্বিশ্বের বিভিন্ন কারণে এপ্রিলে শুরু হতে যাওয়া অর্থবছরে জাপানের মন্দায় নিমজ্জিত হওয়ার ঝুঁকি ক্রমে বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখা বিওজের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে দুইদিনের নীতিনির্ধারণী বৈঠকের পর আগামী অর্থবছরের জন্য ভোক্তা মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস ১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৯ অর্থবছরের জন্য প্রথম মূল্যস্ফীতি পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের এপ্রিলে। তার পর থেকে চারবার এ পূর্বাভাস পরিবর্তন করেছে বিওজে। এছাড়া কোর ভোক্তা মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাসও কমিয়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ নির্ধারণ করেছে বিওজে।
অনেক অর্থনীতিবিদই ধারণা করছেন, বিওজের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে মুদ্রানীতিমালা স্বাভাবিকীকরণ। নীতিনির্ধারণী বৈঠকে বিওজে স্বল্পমেয়াদি সুদহারের লক্ষ্যমাত্রা ঋণাত্মক দশমিক ১ শতাংশে অপরিবর্তিত রেখেছে। সেই সঙ্গে ১০ বছর মেয়াদি সরকারি বন্ডের ইল্ড শূন্যে নামিয়ে আনা হতে পারে।