পিঠা বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধান কাটা উৎসবে কৃষকের ঘরে যখন নতুন ধান ওঠে, সেই ধান ঢেঁকিতে ভেঙে তৈরি হয় নানারকম পিঠা। অগ্রহায়ণের নতুন চালের পিঠার স্বাদ সত্যিই বর্ণনাতীত। এ সময় টাটকা চালে তৈরি করা হয় বাহারি পিঠা পুলি। পিঠার সেই ম-ম গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে মূলত ঋতুর প্রথম ভাগ থেকেই । পিঠা খেতে ভালোবাসা না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রবাসিদের অনেকেই পিঠা খাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। সেই জন্য জাপানে বসবাসরত প্রবাসীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় ৪র্থ আশিকাগা পিঠা উৎসবের। ২৩ ফেব্রুয়ারি রোববার তোচিগি কেনের আশিকাগা সিটিতে বাংলাদেশ কমিউনিটি কিতা কানতোর পক্ষ থেকে সুইয়ামা লুবনার উদ্যোগে পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়। বরাবরের মতই এই আয়োজনের মুল উদ্দেশ্য ছিল প্রবাসীদের পিঠা খাওয়ার অতৃপ্তি কিছুটা দূর করার পাশাপাশি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরাও। জাপানের বিভিন্ন শহরের ১১০ টি পরিবারের ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩৬০ জন এই পিঠা উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। পিঠা উৎসবটি জাপানের কানতো অঞ্চলের বাঙালির এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। নারীদের সবার পরনে ছিল একই রং এর শাড়ি আর পুরুষদের পরনে ছিল বাঙালির প্রিয় পোশাক পাজামা-পাঞ্জাবি।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিলটি সাজানো সোনামণিদের প্রতিভা নিয়ে।
ছোট্ট সোনামণি ফিদিয়ানার সুরা পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় পিঠা উৎসবের। এই পবে ছোট সোনামণিদের আরবি সুরা পাঠ ,নাথে রসুল, কবিতা , নাচ ও গান এই পর্বটি পরিচালনা করেন ফারজানা ইমু ।এই পর্বে সুরা পাঠ করে তিরানা, সাফিন, আয়ান, আরিয়ান, মিমনুন, নাবা, ফৌজি ও মারিয়াম লিসা। কবিতা পাঠ করে আয়ান, নামিরা, মুহিন ও সামিন। নাথে রসুল পরিবেশন করে করে মিনমুন ও ফৌজি , গান করে আরোহা। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা পর্বটি পরিচালনা করেন অনেক গুনে গুণান্বিত আয়শা মিতু। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাই রায়াত, নাহিয়ান, রাসিফ, সোরা, রুজেন , আরোহা, আয়ান, মীমনূন, সুহান, আরিয়ান, ফৌজি, রাইনা, সামিন , খাদিজা ও রেইয়ান । প্রথম পর্ব শেষে সকল সোনামণিদের হাতে বই কেনার জন্য গিফট কার্ড হাতে তুলে দেন আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ।
মধ্যাহ্নভোজনে পোলাও , বিফ বুনা , খাসীর মাংস , রোস্ট, বাটার চিকেন ও সালাদ।
দ্বিতীয় পর্বে ছিল পিঠা প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই মহান ভাষা শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরাবতা পালন করা হয় এবং জাপান প্রবাসীদের প্রিয় মুখ মেনন হুদার মৃত্যতে শোক জ্ঞাপন করা হয়।
উপস্তিত সকল দর্শকরা দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে আমার ভাইয়ের রক্ত রাগানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি পরিবেশন করেন, গানের সাথে নৃত্য করতে থাকে সবার প্রিয় সোনামণি নাবা সেই সময় ছোট্ট সোনামণিরা শহীদ মিনারে ফুল অর্পনের মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরু করা হয় করে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন শাম্মি বাবলি, রেইন করিম, খাইরুল মুন ও নওশী কবিতা আবৃতি করেন আয়শা মিতু। জাপানে জন্ম, বেড়ে উঠা তরুণী ইউমি বড়ুয়া মনমুগ্ধকর বাংলা গান পরিবেশন করে এই সময় পিয়ানো বাজান লিনা বড়ুয়া। শিশু শিল্পী রেইয়ান ও সোহা দুই বোনের জাপানিজ গানের সাথে নৃত্য সবার মন কেড়ে নেয়। এরপর সবার মন মাতানোর জন্য নৃত্য নিয়ে আসে আসাধারন প্রতিভার আধিকারি ক্ষুধে শিল্পী নাবা। বারাবরে মতই সবাই দারুন উপভোগ নাবার নৃত্য।আয়োজকদের পক্ষ হতে নাবা কে বিশেষ ভাবে পুরস্কৃত করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর আরম্ভ হয় আসিকাগা পিঠা উৎসবের সব চাইতে আকর্ষণীয় পর্ব পিঠা প্রতিযোগিতা।
নিজ হাতের তৈরি পিঠা নিয়ে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন ২৭ জন প্রতিযোগী। পিঠা প্রতিযোগিতায় ছিল পাঁচটি বিভাগ। প্রতিটি বিভাগের জন্য ছিল আলাদা আলাদা নম্বর। টোকিও বৈশাখী মেলার সমন্বয়কারী মো. আসলাম খন্দকার হিরা, বাদল চাকলাদার, রেজা মীর , লেখক-সাংবাদিক কাজী ইনসানুল হক, শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পী শাম্মি বাবলি ও স্রধাভাজন নূর এ আলম ঢালী । । প্রতিযোগিতা শেষে মো. আসলাম খন্দকার হিরা বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করে। এই সময় পিন পতন নিরাবতা নেমে আসে। প্রতিযোগিতায় বিচারকদের রায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন রাবিতা নওশী।তিনি তৈরি করেন তালের পিঠা। চন্দকুলি পিঠা তৈরি করে প্রথম রানারআপ নির্বাচিত হন সৈয়দা লাইলা পারভিন পার্সিয়া , লবঙ্গ লতিকা পিঠা তৈরি দ্বিতীয় রানার আপ নির্বাচিত হন পিউলি ।ভাপা পিঠা তৈরি করে চতুর্থ স্থান আধিকার করেন খোদেজা আক্তার মুক্তা।পঞ্চম স্হান অধিকার করেন যৌথ ভাবে সাজিয়া জয়তি ও আফসানা সানী। উনারা তৈরি করেন যথাক্রমে ঝাল কুলি পিঠা ও ফুল ঝুড়ি পিঠা।
বিজয়ীদের ট্রফি তুলে দেন নূর এ আলম ঢালী, কাজী ইনসানুল হক, বাদল চাকলাদার, রেজা মীর ও শাম্মি বাবলি। চ্যাম্পিয়ন রাবিতা নওশীকে মুকুট পড়িয়ে দেন বিগত বছরের চ্যাম্পিয়ন খোদেজা আক্তার মুক্তা।
পিঠা প্রতিযোগিতার বিজয়িদের জন্য ছিল জাপানের জনপ্রিয় অনলাইন সপ NB Elegant এর পক্ষে হতে পাঁচটি আকর্ষণীয় উপহার। বিজয়িদের হাতে পুরুস্কার গুলো দেন NB Elegant এর কর্ণদার ফারজানা আহমেদ । পিঠা প্রতিযোগিতার আকর্ষণীয় এই পর্বটি পরিচালনায় ছিলেন সুইয়ামা লুবনা।
এরপর ছিল সবাই আধির আগ্রহে থাকা পিঠা ভোজন। মজাদার প্রায় ৫০ রকমের পিঠা দিয়ে সাজানো হয় পর্বটি। উল্লেখযোগ্য পিঠার মধ্যে ছিল ভাপা, বিবিখানা, পাটিসাপটা, মুগপাকন, চিতই পিঠা ,ফুলঝুড়ি, তেলের পিঠা, নারিকেলের পুলি, রঙিন পাটিসাপটা, কিমা ফুলি, নারিকেলের পাকন ও সুজির রস মঞ্জুরি পিঠা। মিষ্টান্নের মধ্যে ছিল রসগোল্লা ও কাপ কেক। ঝাল আইটেমের মধ্যে ছিল শিঙারা ও ঝাল কুলি । মুনিরা চাঁদনীর হাতে তৈরি বিবিখানা পিঠার কেকটি ছিল আসাধারন সুন্দর। পিঠা গুলো তৈরি করেন দীপা, সোমা ফারহা, সাজেদা হাসান, আয়শা মিতু, খাদিজা শেলি, মারিয়াম সাথী, বাপ্পী উম্মে সালমা, কাকলী, সুবর্ণা মিত্রা, আইরিন জাকির, মারিয়া আরজু, সাদিয়া জাহান, শাওনা, নাহিদ তৃনা, নিপুন, ফাতেমা কাজল, তাসনুভা, মুন হায়দার, খাইরুল মুন, রোকেয়া, ফারজানা জাবিন, খুরশীদা হোসাইন ।
পিঠা উৎসবের সব শেষে ছিল অন্যতম আকর্ষণ ছিল র্যাফেল ড্র। র্যাফেল ড্র চলার সময় সবার মধ্যে ছিল চরম উত্তেজনা। র্যাফেল ড্রতে সাতটি আকর্ষণীয় পুরুস্কারের মধ্যে প্রথম পুরুস্কার জিতে নেন মোহাম্মদ মনোয়ার ইকবাল।আকর্ষণীয় পর্বটি পরিচালনা করেন নোমান সৈয়দ। তাঁকে সহযোগিতা করে পাঁচজন ছোট সোনামণি ও লুৎফুর শোভন।
পিঠা উৎসবে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন দিদার কচি, মো. আসলাম খন্দকার হিরা, ইনসানুল হক, নূর এ আলম ঢালী, জসিম উদ্দিন, বাদল চাকলাদার, রেজা মীর, শাহিন রহমান ও চৌধুরী শাহিন।
কানতো অঞ্চলের শিশুদের পক্ষ থেকে লেখক-সাংবাদিক কাজী ইনসানুল হককে বিশেষ ভাবে সম্মানিত করা হয়।
সাউন্ড সিস্টেম ও মিউজিকের দায়িত্ব পালন করেন এ এম রাহাত। আয়োজকদের পক্ষ থেকে সাংবাদিক ফখরুল ইসলাম, তরিকুল ইসলাম ও আল মানুনকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান নোমান সৈয়দ।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রহমান মনি , রতন, সজিব,কুমার নন্দী, হোসেন শা, জেকি মাহামুদ , তুহিন করিম, খাঁন আজম, সিদ্দিক, শাহাজাহান সাজু, দেলোয়ার মোল্লা , রুমন হুদা সহ বাংলাদেশ প্রবাসী ব্যবসায়ী, লেখক, সাংস্কৃতিক কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বাংলাদেশ কমিউনিটির নেতারা। করোনা ভাইরাসের ভয়কে উপেক্ষা করে দূরদূরান্ত থেকে সবাই সমবেত হন অনুষ্ঠানে।আয়োজকদের পক্ষ থেকেই হলের প্রবেশ মুখেই রাখা ছিল মাস্ক ও জীবানু নাশক স্প্রে যা সবার প্রশংসা কুড়াই।
বর্ণাঢ্য এই পিঠা উৎসবের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন সুইয়ামা লুবনা। তাকে সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করেন আইলা কবির, শান্তা ,মুন,দিপা,মিতু,হুমায়ুন, শাহাদাৎ, আলম , ফরহাদ, জনি , সাজ্জাদ ,সামসু, মানিক, রায়হান, জুয়েল, মিন্টু ,বাবুল, আজাদ ,জাকির ও বেলাল সহ অনেক ভাই ও ভাবিরা।
অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকদের পক্ষ হতে সবাইকে ধন্যবাদ জানানো হয়।
তথ্য ও ছবিঃ রাজু