শাহজাহান সিরাজ
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: গোলাম মাসুম জিকো
————————
প্রশ্ন:
আপনার জাপান প্রবাস জীবন ও এবারের টোকিও যাত্রা নিয়ে জানতে চাই
উত্তর:
আমি মুলত জাপানে বসবাস করি ২০১১ সাল থেকে, নিগাতায়। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল, বাঙালী যারা টোকিওতে কাজ করে, তাদের সাথে একটা মিটিং করার। সেই মুহুতে আমাকে জাপান-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব, আমাকে আমন্ত্রণ জানাল। টোকিওতে একটি সেমিনার হবে, সেখানে যেন আমি আমার অভিজ্ঞতা এবং আমার ভিউ শেয়ার করি, সেজন্যই এবার এখানে আমার আসা।
এখানে মিডিয়া বিষয়ক অনেক বক্তব্য নেওয়া হয়েছে, আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল “Modern trends of digital art photography and photojournalism”. অনুষ্ঠানে জাপান প্রবাসী অনেক সাংবাদিক, লেখক এবং মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব উপস্থিত ছিলেন। আমার বক্তব্য সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন, এপ্রেশিয়েট করেছে। আমি খুব আনন্দিত ও অনুপ্রাণিত। পাশাপাশি অন্যরা অনেক কাজ করছেন। সেটা জেনে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। আমরা প্রায় সবাই বাংলাদেশী ছিলাম আমি জেনে খুব অবাক হয়েছি। বাংলাদেশী হলেও, বিদেশে বসবাস করলেও, সবাই ভালোবাসার সাথে দেশের মিডিয়া ও উন্নয়নে কন্ট্রিবিউট করছে। ।বিষয়টা আমার খুব ভালো লেগেছে – শুধুমাত্র বাংলাদেশে থেকেই না; বিদেশে থেকেও, যদি ইচছা থাকে, দেশের অনেক উপকার করা সম্ভব। দেশের জন্য কাজ করার সম্ভব।
প্রশ্ন:
মাল্টিমিডিয়া, উন্নয়ন ও সাংবাদিকতা জগতে কিভাবে আসলে। আমি যতদূর জানি আপনি ভূ-বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের ছাত্র!
উত্তর:
আমি একাডেমীকেলি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছি জিওলজিতে, ভূ-বিজ্ঞানে। ১৯৯৫ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি করার পর, ভাবলাম- সামাজিক উন্নয়নে আমি যদি কন্ট্রিবিউট করি, সেক্ষেত্রে আমার পেশাগত আইডেন্টিটি বিজ্ঞানী হওয়ার চেয়ে ভালোভাবে দাঁড়াবে। পেশাজীবিতার পাশাপাশি সমাজকেও আমি অনেক কিছু দিতে পারবো।
আমি ১৯৯৫ সাল থেকে যাত্রা শুরু করি। আপনি জানেন সেই সময়টা থেকেই ডিজিট্যাল মিডিয়া বাংলাদেশসহ সারাদুনিয়াতে দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছিলো! মর্ডার্ন টেকনোলজি বিশেষ করে মাল্টিমিডিয়া টেকনোলজি দ্রুত গ্রুইং হচ্ছিলো! সে বিষয়ের দিকে আমার একটু নজর গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলামমাল্টিমিডিয়া তো বড় একটা বিশাল বিষয়। জীবনের এবং সমাজের অনেক বিষয় নিয়ে এখানে কাজ করা সম্ভব। বিজ্ঞান বিষয় চেয়ে সোশ্যাল ইস্যু বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ! সেজন্য আমি নিজেকে পাচঁ বছর গড়ে তুলেছি। স্বেচ্ছায় প্রাবেকাত্ব বেছে নিয়েছিলাম। অভাবের মাঝেও, আমি উদ্যাাম নিয়ে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, কৃষি, শিল্প ও পরির্বতেরন আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়গুলো পড়েছি, যা বাংলাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়না। হাল ছাড়িনি!
পড়ালেখার পাশাপাশি আমি কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিংা টেকনোলজিও শিখেছি। ভিডিও এডিটিং, ফটোগ্রাফির পাশাপাশি মাল্টিমিডিয়া প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক্স, এনিমেশন ইত্যাদি দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করিছি। নতুন বিষয়গুলো শিখতে আমি বেশ মজা পেতাম, আনন্দ দিত। যে বিষয় নিয়ে বাংলাদেশে কাজ হয় না; সেই বিষয়ের উপর কনসেন্ট্রেশনে আগ্রহী হয়েছিলাম। শুধুমাত্র ট্রাডিশনাল ফটোগ্রাফি বা ট্রাডিশনাল ভিডিওগ্রাফি না , কিভাবে ‘ICT for Development’ অর্থাৎ ‘Information Technology for Development’ নিয়ে কাজ করা যায়, তা নিয়ে ভাবতাম। সেই জন্য আমি প্রথমে শুরু করেছিলাম ব্লগিং। মেইল লিষ্টিং। ব্লগিং তখন খুব বেশি জনপ্রিয় হয় নাই, তারপরেও HTML ওয়েবসাইট বানিং প্রচার করতাম।
প্রশ্ন:
প্রফেশলনাল জীবনটা কিভাবে শুরু হয়েছিল? শুরুর অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?
উত্তর:
২০০১ সালে যখন আমি মাল্টিমিডিয়ার বিভাগীয় প্রধান হিসাবে দৃকে যোগদান করেছিলাম। তখন থেকেই আমার ভিউ আর কাজ করা সুযোগ বদলে যায়। যুক্তহলো অপনার সম্ভবনা! শুধু বাংলাদেশে না সারা দুনিয়া থেকে বাংলাদেশে; দৃকের মাধ্যমে অনেক মিডিয়া এক্টিভিষ্ট বাংলাদেশ কাজ করতে আসতো। তাদের সঙ্গে আমার একটু সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল! দৃকে থাকতে আমি একটি পোর্টাল এর এডিটর ছিলাম। পোর্টালটির নাম ছিল banglarights.net । সেই বাংলারাইটস্ কে কেন্দ্র করে; আমি আমার সারা দুনিয়াতে হিউম্যানরাইট্ এবং উন্নয়ন বিষয়ক এক্টিভিস্ট বন্ধুত্বের সুযোগ পেয়েছিলাম। যা আমাকে আশার আলো দেখিয়েছিল। সেই বন্ধত্ব ও প্রেরণা আজো আছে। আমার ভিতর প্রবল আস্থা জেগেছিল নিজেকে ও ভাবনা নিয়ে! অন্যদের কাজের সঙ্গে তুলনা করে, অন্যদের কাছ থেকে শিখে ও অনুপ্রাণিত হয়ে, আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম – আমি পারবো। আমার কাজের পরিসরটাকে দিন দিন বাড়বে। সমাজকর্মের পাশাপাশি জীবনযাপনের জন্য আমি একটি স্থায়ী রোজগারে পথও খুঁজে ছিলাম। বাংলাদেশ যেহেতু একটা উন্নয়ানশীল দেশ, বাংলাদেশে অনেক এনজিও কাজ করে। ভেবেছিলাম, তাদেরকে আমি যদি মর্ডার্ন টেকনোলজি ও মিডিয়ায় ট্রেইনআপ করতে পারি, ভা তাহলে ভালো হবে। রুজির পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারবো। সেই ইচ্ছা থেকেই উন্নয়ন বিষয়ে কাজ শুরু করে ছিলাম।
প্রশ্ন:
বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি ও ফটো জার্নালিম নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা ও মোতামত কি?
উত্তরঃ
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, সে কারণে- ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম, ফটো জার্নালিজম বেশ জনপ্রিয়। ফটোগ্রাফিতে, শুধু বাংলাদেশের সাউথ এশিয়ান দেশ গুলোর বাস্তবতা একই! ফটোগ্রাফি মানেই যেন- সোশ্যাল ইস্যু। ষ্টরিটেলিং এর কারণে নেগেটিভ প্রেজেন্টেশন, করুণ বাস্তবতা প্রধান হয়ে যায়। যদিও সমাজে অনেক পোস্টিটিভ দিক আছে; কিন্ত গুরুত্ব কম পায়, গুরুত্ব কম দেয়া হয়। ইনফরমেশন ও বাস্তবত যাদে একগেঁয়েমি ভাবে যাতে মিডিয়াতে না আসে; সেজন্য আমার মত- নতুন ও অন্যএকটা ফ্ররমে, শৈল্পিক ফ্ররমে পজিটিভ দর্শন ও ভাবনা নিয়ে কাজ করা জরুরী। তাহলে দেশ ও সমাজ অনেক উৎসাহিত ও উপকৃত হতে পারে। সাংবাদিকত ও ফটোগ্রাফিতে নতুন ধারা চালু হতে পারে। যদিও কাজটা অনেক চেলেঞ্জিং হবে, তারপরও করা দরকা।
নতুন ধারা চালু উদ্দেশ্য থেকেই আমি ফটোগ্রাফির একটা ভিন্ন নিজস্ব ফ্রম বাংলাদেশে দাঁড় করানোর চেষ্ট করছি। আমি দিন দিন জীবন ও দর্শন কেন্দ্রিক আর্ট ফটোগ্রাফির প্রতি মনোযোগী।হচ্ছি আর্ট ফটোগ্রাফি ও সোশ্যাল ইসু দুটা মিলে একটা জয়েনলি শিল্পী আনার আমার বর্তমান কাজের বিষয়।
প্রশ্ন:
আপনি তো ফটোগ্রাফি, লেখালেখি ওয়েব ডিজাইনের পাশাপাশি ডকুমেন্টরীও তো বানান, সে বিষয় যদি একটু বলেন
উত্তরঃ
আমি ফটোগ্রাফি ও ওয়েবের মত বাংলাদেশের সোশাল ইস্যু নিয়ে ডকুমেন্টারী তৈরী করি। একটি সিরিয়াস ডকুমেন্টারী তৈরী করতে আপনি জানেন অনেক টাকা প্রয়োজন পরে। আমি মুলত উন্নয়ন বিষয়ে ট্রডিশ্যানাল ডুকুমেন্টারি বানাই। অবশ্যই সিরিয়াস কাজের ইচ্ছা আছে। প্রযোজক পেলে অবশ্যই বানাবো। ডিজিট্যাল ড্রিষ্টিবিউশন ও কপিরাটস্ ‘ল’ ইম্পিমেন্টের কারণে বাংলাদেশে প্রযোজকরা ইনভেষ্ট করতে চায় না, বিশেষকরে সোস্যাল ইস্যুতে।
জিওলজিতে পাস করার পর আমি মনে করতাম; জিওলজি পড়াটাই পানিতে গেল। মাল্টিমিডিয়া ও ডকুমেন্টারীর সাথে লিংক করা যাবে না। কিন্তু ভিন্ন ফল পাচ্ছি। আপনি জানেন; বাংলাদেশ জলবাযূ পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিকর দেশের একটি! পরিবেশ ও জলবায়ূ পরির্বতন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জিওলজি পড়ার কারণে আমি বিষয়গুলো অন্য ফ্লিমমেকারে চেয়ে আমি একটু এগিয়ে আছি। পরিবেশ বিয়ষের সবকিছুই জিওলজিতে পড়ানো হয়। ক্লাইমেন চেইন্জ ও পরিবেশ ইস্যু নিয়ে আমি অনেক গুলো ডকুমেন্টারি বানিয়েছি।
পারিবারিক প্রয়োজনে, আমি ২০১১ সাল থেকে জাপানে থাকলেও, জাপানে অনেক কাজের অপুরচনাটি থাকলেও আমি জাপানে কাজ করি কম। প্রথম থেকে আমার ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে কাজ করব। এখনও তাই করি। আমি যখন কোনো ডুকুমেন্টারীর কাজের সুযোগ পাই; তখন বাংলাদেশ ইস্যু নিয়েই আবেদন করি। ইস্যু নিয়ে কাজ করার জন্য আমি বাংলাদেশে চলে যাই। বাংলাদেশে থেকে ফ্লিলিমিং করার পর; আমি জাপানে এডিটিং করি। বাংলাদেশ সহ সারা দুনিয়াতেও ডিষ্টিভিশন করি। বাংলাদেশের মানুষকে উন্নয়ন উদ্যাগকে প্রচার করে উৎসাহিত করার চেষ্টা করি। যাতে বাংলাদেশ জাপানের মতো একটা উন্নত দেশ হতে পারে।
প্রশ্ন:
আর লেখালেখি?
উত্তরঃ এখন তো ডিজিট্যারের যুগ। প্রিন্টিং বই তো তেমন চলে না । তারপরও, ‘আশার আলো’ নামে আমার একটি উপন্যাস আছে। প্রতিদিনই ফেইজবুক সহ সোস্যাল ইস্যু নিয়ে কিছু না কিছু লেখার চেষ্টা করে। এবারের বই মেলায়, ‘জাপান স্মতি, বাংলা প্রীতি’ নামে একটি বই প্রকাশের ইচ্ছা আছে, যার বেশ কয়েকটি অধ্যায় ‘BDNEWS24’ এ প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন:
কোন কোন জেলায় কাজ করেছেন? কাদের সঙ্গে কাজ করেছেন?
উত্তরঃ
আমি বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ জেলায় কাজ করেছি। বাংলাদেশের প্রথম সারির এনজিও, আন্তজার্তিক উন্নয়ন সংস্থা যারা আছে, তাদের প্রায় সবার আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
প্রশ্ন:
আপনি তো আদিবাসীদের উপর কিছুদিন আগে একটি ডকুমেন্টালি বানালে। আদিবাসীদের সম্পর্ক আপনার অভিজ্ঞতা কি?
উত্তরঃ
বাংলাদেশে আদিবাসী বললেই আমরা বুঝি – চাকমা, সাঁওতাল আর পাহাড়ী গাড়ো (মান্দি) দের। কথাটি ঠিক না । পাহাড়ীদের পাশাপাশি সমতলেও আদিবাসী আছে। বাংলাদেশের সমতলীয় জনগণের পাশাপাশি দৃষ্টির অগচরে ৩৫ থেকে ৩৬টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি আদিবাসী আছে। এদের সবারই জীবন কৃষি ভিত্তিক যাত্রা! প্রকৃতিক নির্ভল। আমার দেখা প্রায় সব সমতলীয় আদিবাসীদের জীবন ও অধিকার মানবেতর। এ বছর যে ডকুমেন্টারীটি বানালাম, তার বিষয় ছিল, ‘সমতলীয় আদিবাসী ও জলবায়ূ পরির্বতন’।
ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রথম আঘাত করে প্রকৃতিতে। প্রকৃতিতে প্রভাব বিস্তার করার ফলে সরাসরি প্রভাব পড়ে কৃষিতে। যেহেতু আদিবাসীদের জীবন কৃষিভিত্তিক জীবন, বিশেষ করে সমতলীয়দের – সেই কারণে তাদের জীবন কিন্তু খুব ভার্নারেবল। কিন্তু দুঃখের বিষয় – মেইনস্ট্রিম ডেভোলপমেন্ট প্রসেস, সরকারী বা বেসরকালী সবাই আদিবাসীদের বিষয়কে হাইলাইট করে না। ভাবখানা এমন এরা মানুষ না, এরা দালিত এদেশের নাগরিক না।
ডকুমেন্টারিটি বানাতে গিয়ে কাজ করেছি – নওগা জেলার পাহান, উড়াওদের উপর। পাশাপাশি খুলনা এলাকার আদিবাসী মুন্ডা উপর। খুলনা, বিশেষ করে আয়লা আক্রান্ত ‘কয়রা’ ও শ্যামনগরে সেলাইনিটি ও সি-লেভেল রাইজিং কারণে কৃষি ও জীবন খুব ক্ষতিগ্রস্থ। পাশাপাশি খরার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ নওগাঁ’র আদিবাসীদের জীবন।
আরো কষ্টের কথা – সমতলীয় আদিবাসীর জীবন – কৃষিভিত্তিক হলেও এদের জমিকেনার অধিকার নাই। আদিবাসীরা জমির মালিকানায় বিশ্বাসী না হওযার কারনে, বংশ সূত্রে পাওয়া জমির দলিল নাই। কুচক্রিমহলে – এদের জমি সহজে দল করে নেয়।
আমার কাজের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছি- দ্রুত পিছিয়ে পড়া নৃ-গোষ্ঠীদের “মেইন স্ট্রীম ডেভেলাপমেন্ট প্রসেস’ এ আনা উচিত। এই বিশাল আদিবাসীদের যদি আমার সমপর্যায়ে আনতে পারি- দেশ ও সমাজের উন্নয়নটা সহজে হবে।
প্রশ্ন: জাপানে কি করেন?
উত্তরঃ
আমি অনলাইনের মানুষ। ঢাকার ধানমন্ডিতে আমার একটি ছোট অফিস আছে। জাপানে বসে অনলাইনে আমি ওদের সঙ্গে কাজ করি। তাছাড়া আমার অধিকাংশ ক্লাইন্ট বাংলাদেশী। আম্রিকা, ডাচ, কানাডা ও মালেশিয়ান কিছু নিয়মিত ক্লাইন্ট আছে।
আমি জাপানে মুলত আটা ফটোগ্রাফি করি। কালচারাল ও ব্লগিং করি। জাপানের থাকার কারণে আমার প্রকৃতি অনুভূতি বদলে গেছে। জাপান চার ঋতুর দেশ। এখানে ঋতুর পরিবর্তন হয় সরাসরি বুঝা যায়। বাংলাদেশও পরিবর্তন হয়, এত শার্প না ।
জাপানের কিছু করার চিন্তা থেকে আমি গভীরভাবে বুঝেছি- জাপানের সংস্কৃতিটা যদিও এশিয়ান; তবুও বাংলাদেশীদের কাছে অজানা, মিসটিরিয়াস, একটু ভিন্ন ধরনের। সাহিত্য, শিল্প, জীবন পদ্ধতি সবকিছুই অন্যরকমের। এখানে একটা জনপ্রিয় কবিতা আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত কবিতা। পাঁচ, সাত ও পাঁচ মাত্রার কবিতা। এই তিন লাইনের কবিতা দিয়ে জাপানিরা – আদি কাল থেকেই চর্চা করে। যার নাম হাইকু। আগে সাধারণত শিল্পীরা ড্রয়িং করার পর পাশে একটা হাইকু লিখতো। আমি ভাবলাম যেহেতু মর্ডান টেকনোলজি এবং মর্ডান ফটোগ্রাফি আছে, ফটোগ্রাফির পাশাপাশি যদি আমি হাইকু লিখি তাহলে মনে হয় জিনিসটা খুব ভালো হবে এবং ইউনিভারসার্ল হবে। বাংলা সাহিত্যে অনেক বিদেশী ফর্ম জনপ্রিয় হয়েছে। যেমন মনে করেন গজল, সনেট ইত্যাদি; হাইকু যদিও এশিয়ান ফর্ম; কিন্তু বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি লেখা হয়নি। তাই ভাবলাম, ফটোগ্রাফির পাশাপাশি যদি হাইকু লিখতে পারি-তাহলে বাংলা সাহিত্যে নতুন একটা ধারা চালু হবে। এতে আমার ফটোগ্রাফির পাশাপাশি সাহিত্যেও অবদান রাখতে পারবো । এজন্য এখন আমি ফটোগ্রাফি এবং হাইকু একসঙ্গে লিখছি, চর্চ্চা করছি। আরেকটা বিষয়- পৃথিবীতে অনেক দর্শন আছে। জাপানের একটি বিখ্যাত দর্শন হলো জেন দর্শন। জেন এসেছে চীন থেকে। বিখাত তাও আর বুদ্ধিষ্ট ফিলোসফি মিলে এই জাপানি মত-পথের সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে জীবনান্দ দাস ও রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর সহ অনেক কবি সাহিত্যিক ভাববাদ চর্চ্চা করেছেন। ইনডিরেক্টলি ‘জেন এবং তাও’ এর প্রভাব আছে অনেকের কাজে । কিন্তু ডাইরেক্টলি শব্দটি খুব কম ব্যবহার হয়েছে। আমি ডাইরেক্টলি বলছি আমার ফটোটগ্রাফি ‘জেন এবং তাও ফটোগ্রাফি’।
প্রশ্ন: আপনার ভবিষত পরিকল্পনা কি?
উত্তরঃ
ভবিষতের কথা বলা তো মুস্কিল। তবে প্রতিবছরই আমার এখন থেকে ১-২টা বই প্রকাশের ইচ্ছা আছে। প্রিন্টিং শিল্পকে, ভাবনে প্রাণ দেয়, দেহ দেয় তরুণ কাল থেকেই আমার ইচ্ছা একজন সৃজনশীল লেখক হওয়ার। আমি লেখালেখি করিও, কিন্তু পেশাগত অতি ব্যস্ততার কারণে বই প্রকাশ মন দিতে পারি না।
আমি আর্ট ফটোগ্রাফি নিয়ে ইদানিং প্রচুর লেখা পড়া করছি। আমার ভবিষত পরিকল্পনা আছে- জাপান ও বাংলাদেশ সহ সারা দুনিয়াতে প্রদর্শনী করার । আমি ফটোগ্রাফি ও হাইকো নিয়ে বই প্রকাশ করবো। বাংলা সাহিত্যে যাতে হাইকু মেইনস্ট্রিম একটা কবিতার ফ্রম আসে।, সেটার চেষ্টা করবো। আমি যদিও কবি না; তারপরও তো নতুন ধারা সৃষ্টিতে তো সমস্যা নাই। কাউকে না কাউকে শুরু করতে হবে। আমার দেখাদেখি হয়তো অনেকেই হাইকু লিখা শুরু করবে। সনেট এবং গজলের মত হয়তো হাইকু জনপ্রিয়তা পাবে।
প্রশ্ন: আর বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি নিয়ে মতামত কি ? বাংলাদেশে এক্ষেত্রে আপনি কিভাবে কাজ করেছেন?
উত্তরঃ
আপনি জানেন দৃক ও পাঠশালা বাংলাদেশের আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অনেক নতুন ও প্রমেজিং ফটোগ্রাফার তৈরী করেছে। দৃক কমার্সিয়াল প্রতিষ্ঠান হলেও; সবসময় একটা শৈল্পীকতা এবং সমাজের দায়বদ্দতা নিয়ে কাজ করে। দৃকের কাজ করার ফলে, যে স্বপ্ন আমার ছিল, তা প্রনোদিত হয়েছে। দৃকে থাকার সময়- ‘পাওয়ার অফ কালচার’ নামে একটা ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্ট করেছিলাম। কালচারাল ব্যাক্তিত্ব, যারা সমাজ পরিবতনের জন্য কাজ করে তাদের ভাবনা গুলো আমি বুঝেছি। ডিজিট্যাল টেকনোলজির কারণে প্রফেশন্যাল ফটোগ্রাফির ব্যবহার চ্যালেঞ্জের মুখামুখি হলেও বাংলাদেশে ফটোজার্নালিমর সব বিষয়ই জনপ্রিয়তা পাবে।
ডিজিট্যাল টেকনোলজির সুবিধার কারণে, শুধুমাত্র বাংলাদেশে না সারা দুনিয়াতে এখন অনেক প্রোডাকশন হয়, অনেক ফটোগ্রাফি হয়। সব কাজ শিল্প কেন্দ্রিক না হলেও, কোনটাই গুরুত্বহীন না । সবচেয়ে বড় কথা – স্মার্টফোনের কারণে সবাই ফটোগ্রাফি করতে পারে। সবাই নিজেকে ফটোগ্রাফার দাবী করতে পারে।
বাংলাদেশে যারা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার তারা এখনো সোশ্যাল ইসু কে ফোকাস করেছে। এটা ভালো দিক। তবে বাংলাদেশ উন্নত হযে গেলে, জাপানের মত প্রয়োজনটা বদলে যাবে। হয়তো প্রডাক্ট ফটোগ্রাফি, মডেল ফটোগ্রাফি ও আর্ট ফটোগ্রাফি মেইষ্ট্রিমে চলে আসবে। বাংলাদেশে অনেক নতুন ফটোগ্রাফার তৈরী হয়েছে। পাঠশালা, দৃক এবং বি বি পিস (বাংলাদেশ ফটোগ্রাফার সোসাইটি) কেন্দ্রিক ফটোগ্রাফারর যদি নতুন ধারার দিকে মনোযোগ দেয়, তবে অনেক ভালো ফল আসবে । যেমন জাপানে ডেভেলপমেন্ট ফটোগ্রাফি নাই বললেই চলে। এখানে কমার্সিয়াল ফটোগ্রাফি এবং আর্ট ফটোগ্রাফি মূলত মেইনস্ট্রিম ফটোগ্রাফি।
দৃকে আমি ২০০১ সাল হতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেছি। আরো বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য ছোট একটা অর্গানাইজেশন বানিয়েছি। যা জাপান এবং বাংলাদেশে কাজ করে। নাম হলো ‘মাচিজো মাল্টিমিডিয়া’ ।
প্রশ্ন: জাপানের কোন ফটোগ্রাফারের কাজ ভালো লাগে?
উত্তরঃ
নিগাতার তাকাশি আমানো আমার প্রিয় ফটোগ্রাফার । এনালগ যুগের প্রায় সব ফটোগ্রাফারে কাজ ভালো লাগে। রিনকো কাওয়াচি, মিকা নিনাগাওয়া, তাকিহিতো মিয়াতাকে, নবোওসি আররি প্রমুখের কাজ অসাধারন। জাপানি তরুণ ফটোগ্রাফারদের কাজের ধরন নতুন, ভিন্ন ও অসাধারন। আমি নিয়মিত ইন্টারনেট ও ম্যাগাজিনে দেখি। জাপান ও বাংলাদেশের মিডিয়া ও ফটোগ্রাফি ইন্ড্রাষ্টিতে কাজের মটিবেশনে বিরাট ভিন্নতা আছে। সঠিক নাও হতে পারে- বাংলাদেশের মটিবেশন; ফটোগ্রাফি করে সেলিব্রেটি হওয়া ও টাকার রোজগার করা অনেকটা মূখ্য। আর জাপানে ফটোগ্রাফার নামের চেয়ে, টাকা ও কাজকে গুরুত্ব দেয়। বলতে গেলে, এখনো পৃথিবীতে ক্যামেরা চার ভাগের এক ভাগ ক্যামেরা জাপানে বিক্রি হয়। মোবাইলের যুগেও সাধারন মানুষ ক্যামেরা কিনে। প্রায় সবাই ফটোগ্রাফি করে। জাপানিরা পারসন কে হাইলাইট করতে চাই না। তারা ইস্যুটাকে, কাজটাকে হাইলাইট করতে চায়। সেজন্য এখানে ‘নাম না জানা’ অনেক ভালো ভালো ফটোগ্রাফার আছে।
প্রশ্ন: জাপানে আপনার ফটোগ্রাফির বিষয় কি? জাপান বাংলাদেশ আরো এ বিষয়ে কিভাবে ঘনিষ্ট হতে পারে?
উত্তরঃ
আমার কাজতে, বাংলাদেশ সেন্টার বেশী। তবে এখন বাংলাদেশের পাশাপাশি জাপানের ইস্যু নিয়েও কাজ করি। কালচারের পাশাপাশি জাপানের প্রকৃতি সংশ্লিষ্ট- আর্ট ফটোগ্রফি, পয়েট্টি ফটোগ্রাফি, ফিলোসোফি ফটোগ্রাফি আমার কাজের এরিযা।
——-
জাপান প্রবাসীরা মনে করি যদি যৌথ প্রজেক্ট করলে ভালো হবে। এর ফলে, ফটোগ্রাফি ও মিডিয়ার পাশাপাশি জাপানের যে ডেভেলপমেন্ট প্রসেসটা বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারবে, বুঝতে পারবে জাপানের সমাজ ও উন্নয়ন। জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে উৎসাহিত বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে, উন্নয়নটা সহজ হতে পারে। পাতাকার মত জাপান-বাংলাদেশের চেতনায় অনেক মিল আছে।
ধন্যবাদ
আপনাকেও ধন্যবাদ
—————————–