জাপানের রাজধানী টোকিও যার পূর্ববর্তী নাম ‘এদো’, ৪০০ বছরের বেশি পুরনো। টোকিও নামকরণ হয়েছে মেইজি মহাসংস্কারের সময় ১৮৬৮ সালে। এদো যুগের শাসক ছিলেন সামুরাই-শাসক শোওগুন তোকুগাওয়া ইয়েয়াসু এবং তাঁর বংশধরগণ (১৬০৩-১৮৬৮)। তাঁরা এদো মহানগরে থেকে স্বতন্ত্র এক নীতি বা পদ্ধতিতে সমগ্র নিহোন/নিপ্পন তথা জাপানকে শাসন করতেন। যাকে বলা হতো সানকিন-কোওতাই (alternate attendance) বাংলায় পর্যায়ক্রমিক অবস্থিতি বললে যথার্থ হবে কিনা জানি না। অর্থাৎ শাসনব্যবস্থাকে সংহত রাখার জন্য প্রদেশসমূহের শাসকদেরকে—যাঁরা ছিলেন সামন্ত বা জমিদার তাঁদেরকে এক বছর বা তারও বেশি রাজধানী টোকিওতে থাকতে হতো পরিবারপরিজনহীন একা। এই পরিবারের জন্যই সামন্তদের অনুগত থাকতে হতো প্রধান শাসকের প্রতি।
এইভাবে ১৮৬২ খ্রি: পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রেখেছিলেন সামুরাই শাসকরা। তখন এদো মহানগরেই এক কোটি লোকের বসবাস ছিল বলে জানা যায়। মেইজি যুগের সূচনালগ্ন থেকেই টোকিওতে পাকা দালানকোঠা গড়ে তোলা শুরু হলো বিদেশি স্থাপত্যবিদদের নকশায়। ১৯২৩ সালের কানতোও মহাভূমিকম্প এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টোকিও বিপুল ধংসের শিকার হলেও বেশকিছু পুরনো স্থাপত্য রক্ষা পেয়েছে যেগুলোকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছে সরকার ও জনগণ। কারণ ভবনগুলো নান্দনিক এবং আলঙ্কারিক—বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণীয় বস্তু। এছাড়া কিছু স্থাপত্য পুনর্নিমাণ করা হয়েছে।
১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাস থেকে আমি টোকিওর বাসিন্দা। তখন টোকিওতে দুটি উঁচু ভবন আমি দেখেছি যতখানি স্মরণে আছে, একটি ইকেবুকুরো শহরে অবস্থিত সানশাইন ভবন এবং অন্যটি তোরানোমোন শহরের কাসুমিকাসেকি ভবন। আর বাকী সব উঁচু ভবন আমার চোখের সামনেই নির্মাণ হয়েছে। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত জাপানের কনস্ট্রাকশন বুমের যুগে বহু ভিসাহীন তরুণ বাঙালি শ্রমিক কাজ করেছেন। তাদের শরীরের ঘামের দাগ এখনো ভবনগুলোর অন্তরে লেগে আছে বলে মনে হয় যখনই ভবনগুলোর দিকে তাকাই! বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে!
বিদেশির কথাই যখন উঠলো, বলতে হয়, জনবহুল টোকিও একটি মেল্টিং-পট। বহু দেশের, বহু জাতের মানুষকে আত্মীয় করে নিয়েছে সে। আজকে ২০ হাজার বাঙালির মধ্যে কয়েক হাজার টোকিওতেই আছেন বলে আমার ধারণা। আর শতাধিক বিখ্যাত বাঙালি টোকিও ভ্রমণ করেছেন নানাভাবে। সেই বিপ্লবী হেরম্বলাল গুপ্ত ১৯০২ সালেই টোকিওতে ছিলেন বলে কুসাবিরাকি সানজোও নামক জাপানি শিক্ষকের গ্রন্থ থেকে জানতে পারি। (হেরম্বলাল গুপ্তকে নিয়ে আমার দীর্ঘ প্রবন্ধ আছে ‘জানা অজানা জাপান’ তৃতীয় খণ্ডে, প্রকাশক অনুপ্রাণন প্রকাশন, ঢাকা।) আর গত রোববার সাক্ষাৎ হলো টোকিওতে এইসময়কার জনপ্রিয় টিভি-ব্যক্তিত্ব জহিরুল আলমের সঙ্গে—আপাত আমার জানামতে শেষ খ্যাতিমান বাঙালি টোকিও ভ্রমণ করে গেলেন।
টোকিও আজকের দুনিয়ায় বিখ্যাত নানা কারণেই। অত্যাধুনিক সভ্যতার চোখ-ধাঁধানো নিদর্শন যেমন প্রচুর ঠিক সেসবের আশেপাশেই পুরনো-প্রাচীন সৌন্দর্যকে অপরিসীম মমতায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ভূমিকম্পপ্রবণ জাপানের রাজধানী মেট্রোপলিটান টোকিও এখন ৯.২৭৩ মিলিয়ন মানুষের ভার বহন করছে (২০১৫)। ইটপাথরের সুরম্য দালানকোঠার এক বিপুল জঙ্গল এই মহানগরটি। ওপর থেকে দেখলে তিল ধারণের জায়গা আছে বলে মনে হয় না। অথচ এখনো প্রচুর সবুজ। ঢাকায় যা চিন্তাও করা যায় না! পাঁচটির অধিক বিশাল জাতীয় উদ্যান এই শহরে সবুজকে আগলে রেখেছে। হাজার হাজার ছোট-বড় উদ্যান, খেলার স্থান তো আছেই। এবং এমন সুন্দর পরিপাটি পরিকল্পনায় সাজানো শহরটি অন্ধমানুষও অনায়াসে হেঁটে যেতে পারেন।
২৩টি ছোট-বড় ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত মূল টোকিও মেগাসিটি, কিন্তু এর বাইরেও সংযুক্ত আছে তার সঙ্গে গ্রাম, দ্বীপ এবং দূরবর্তী অঞ্চল। আধুনিক শহর গড়ে উঠছে ২০২০ সালের অলিম্পিক গেইমকে কেন্দ্র করে টোকিও-বে’কে ঘিরে। শহরগুলোকে নতুন সাজে সাজানো হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার মজবুত করা হচ্ছে বিদেশি পর্যটকদের জন্য। ক্রমাগত এই যে টোকিওর পরিবর্তন তাতে তার বৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ নেই—আতরুণই থেকে যাচ্ছে সে। আর এটাই হওয়া উচিত একটি রাজধানীর বৈশিষ্ট্য।
টোকিওর প্রায় প্রতিটি শহরেই রয়েছে বিপুল-বিচিত্র খাবার ও পানীয়র দোকান, পানশালা, নাইটক্লাব, সিনেমা, নাট্যমঞ্চ, কাবুকি-নোহ্ থিয়েটার, সান্ধ্য-কনসার্ট, জাদুঘর, গ্রন্থাগার, গেইম-সেন্টার, শপিংমল, ডিপার্টমেন্ট স্টোর্স, রিভার ক্রুজিং, খেলা দেখার ডোম, সুমো-ক্রীড়া, প্রদর্শনী-মিলনায়তন, আলোকচিত্র জাদুঘর, রেল-জাদুঘর, ১৩০টির বেশি ছোট-বড় বিশ্ববিদ্যালয়, পুরনো গ্রন্থশহর ইত্যাদি ফলে মানুষের আনন্দ-বিনোদনের কোনো ঘাটতি নেই। আর সর্বত্রই নিরাপদ। কি খাওয়া-দাওয়াায়, কি যাতায়াতে। তারপরও পুলিশকর্মীরা সজাগ।
এখন মেগাসিটি টোকিওর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলো হচ্ছে, জিবিলি মিউজিয়াম (অ্যানিমেশন-আর্ট), টোকিও স্কাই ট্রি (টোকিওর নতুন প্রতীক), টোকিও ডোম, টোকিও জয় পোলিস, টোকিও টাওয়ার, ওদাইবা (টোকিও উপসাগর), টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়াম, টোকিও ফরেইন আর্ট মিউজিয়াম, হারাজুকু (তরুণদের ফ্যাশনাবল শহর) এবং গিনজা (বিশ্বফ্যাশন বাজার)। গিনজা শহরটি বিশ্বের অতিব্যয়বহুল শহরগুলোর অন্যতম। এখানে বিশ্বের বিখ্যাত ফ্যাশন হাউজ সবগুলোর শাখা বিদ্যমান। রয়েছে জাপানের বিশ্ববিখ্যাত ডিজাইনারদের বৈচিত্র্যময় পোশাকের শোরুম।
শহর জুড়ে রয়েছে একাধিক নদীনালা সেই প্রাচীনকাল, মধ্যযুগ থেকে, ভরাট করা হয়নি কিছুই। বরং নদীর তলদেশ দিয়ে প্রবাহমান করা হয়েছে জলনিষ্ক্রমণকে। আগে যেমন টোকিওর বিভিন্ন অঞ্চল বন্যায় কবলিত হতো, এখন আর হয় না, বিপুল টাকার প্রকল্প হিসেবে মাটির তলদেশ দিয়ে বৃষ্টির জল নেমে যাওয়ার সুড়ঙ্গপথ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু শহরটি সুন্দর, ঝকঝকে বলে বৃষ্টির মধ্যে ছাতিমাথায় হাঁটার মধ্যে এক ধরনের রোমান্টিকতা আছে। বৃষ্টির দিনে রাস্তার পাশে বা গলির ভেতরে আলোঝলোমল সুশি খাবারের দোকানে সামুদ্রিক কাচা মাছের স্বাদ আর টলটলে নিহোনশুউ-মদের ঝাঁঝ মিলেমিশে দারুণ জমে ওঠে প্রাচ্য-রোমাঞ্চ!
টোকিও যেমন একটি বিমুগ্ধ শৈল্পিক-নান্দনিক মহানগর তেমনি একটি কাব্যিকনগর বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না।রাজপথের পাশে, অলিগলির পথে পথে রয়েছে পুরনো স্থাপত্য, অজস্র কাঠের মন্দির—প্রতিটি মন্দিরসংলগ্ন সবুজ প্রাঙ্গণ দৃষ্টিকে থমকে দেয়। পথের পাশে রয়েছে ধাতব ইতিহাসপরিচিতি। গন্তব্যস্থলে যাওয়ার সুদর্শন মানচিত্র।উষ্ণমৃদু কফিশপ, গ্রন্থ-ম্যাগাজিনপাঠ্য কাফে, আধুনিক-বাহারি চিত্রাঙ্কনসম্বলিত উচ্ছল-তারুণ্যের প্রতীক ম্যাক-ডোনাল্ডস, পুরনো নস্টালিজক ছিমছাম অনুচ্চ রুনোয়ার রেস্টুরেন্ট, রাজপথের পাশে সবুজ বৃক্ষতলের উন্মুক্ত কফি ও পানশালা জুড়ে কী দারুণ কাব্যিকতার ছড়াছড়ি, ছন্দের ওড়াওড়ি! তারুণ্য-পৌঢ়ত্বর মাখামাখি দেখে থমকে দাঁড়াতেই হয়! এক কাপ কফির সুবাস কিংবা লেবুর স্বাদমেশানো লাল চা’র উপশম অথবা ফেনাযুক্ত ঠাণ্ডা বিয়ারের মাদকতা সহসাই গ্রন্থরাজ্যে বা রঙিন গ্লোসি-ম্যাগাজিনের অজানা অন্দরে নিয়ে যায় মনকে! ভাবি, এই না হলে শহর! এই না হলে মানবনগর!
অন্যান্য শহরগুলোর মতো টোকিওতেও প্রতি বছর বসন্ত আসে, আসে হেমন্ত এবং গ্রীষ্ম। সম্পূর্ণ পাল্টে যায় নাগরিকদের জীবনযাপন।বসন্তে হালকা গোলাপি রঙের সাকুরা ফুলের তরঙ্গরাজি দুলতে থাকে উদ্যানে, নদীর তীরে, খালের পাড়ে, মন্দিরের প্রাঙ্গণে। জমে ওঠে সাকুরা দেখার উৎসব ‘হানামি’; গ্রীষ্মের দাবদাহ টোকিওকে কাঁপায় কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় উৎসবে মেতে ওঠে আবালবৃদ্ধবনিতা। সবচে বড় উৎসব আতসবাড়ি পোড়ানো যাকে বলে ‘হানাবি’ নদীর তীরে তীরে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। হুমড়ি খেয়ে পড়ে টোকিওবাসীরা। আর হেমন্তে সমস্ত টোকিও লাল-হলুদে রাঙা হয়ে ওঠে—যেন তার গায়ে হলুদ—তারপর চলে যাবে অনাত্মীয়র দেশে—শীতের হিমরাজ্যে। শীতল বাতাসে সব পাতা ঝরে গিয়ে গেরুয়া রূপ ধারণ করলেও টোকিওর হৃদস্পদন কখনো হিম হয়ে যায় না! টোকিও চিরসবুজ, চিরমুখর, চিরউষ্ণ, চিররঙিন এবং চিরদুরন্ত!
বিগত প্রায় ৩৫ বছর ধরে কত আড্ডা দিয়েছি কতজনের সঙ্গে টোকিওর এখানে-ওখানে তার ইয়ত্তা নেই! এইজন্যই নাম দিয়েছিলাম একটি সংগঠনের “আড্ডা টোকিও” কারণ আড্ডা দেবার একেবারে আদর্শ শহর হচ্ছে মেগাসিটি টোকিও। আমার দ্বিতীয় পালক-শহর।