২০১৫ সালের জুন মাসের ঘটনা। দিনাজপুরে লিচু খেয়ে মারা যায় ১১ শিশু। এর আগে ২০১২ সালেও এরকম ঘটনা ঘটে। সে বছর লিচু খেয়ে একই জেলায় মারা যায় ১৩ শিশু। লিচু খাওয়ার পর ওই শিশুদের খিঁচুনি শুরু হয়, এরপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ফলাফল অবধারিত মৃত্যু। কিন্তু লিচু খেয়ে কেন শিশুরা মারা যায়? কারো কারো ধারণা লিচুতে বিষ প্রয়োগ করা হয়, লিচু রং বাড়ানোর জন্য কেমিক্যাল দেওয়া হয়, ভাইরাসবাহিত কোনো পোকা-মাকড় লিচুকে স্পর্শ করলে তা বিষাক্ত হয়ে পড়ে। ফলে শিশু খেলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। লিচু খেয়ে শিশু মৃত্যুর পেছনে আর কী কোনো কারণ আছে? নিশ্চয় আছে। লিচু খেয়ে শিশু মৃত্যুর হার কেবল বাংলাদেশে নয়, ভারতেও লিচু খেয়ে মারা যায় অনেক শিশু। ২০১৪ সালে বিষয়টি সামনে এনেছিল সর্বভারতীয় একটি সংবাদসংস্থা৷ দাবি ছিল সাংঘাতিক৷ ১৯৯৪ সালে ২০১৪ সালের মধ্যে রহস্যজনকভাবে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয় কমপক্ষে ১০০০ জন শিশুর৷
ফলে কারণ উদঘাটনে গবেষণা শুরু করে ভারত। সম্প্রতি ভারতীয় গবেষণার ফলাফলে জানা গেল লিচু খেয়ে শিশু মৃত্যুর কারণ। ভারতের এপিডেমিক ইন্টালিজেন্স সার্ভিসের একজন গবেষক ড. রাজেশ যাদব তিন বছর আগে মোজাফফরবাদের এক শহরে যান। এখানে এক রহস্যময় রোগের প্রাদুর্ভাবে শিশুর মৃত্যু হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। যার কারণ সম্পূর্ণ অজানা। তিনি তিন বছর ধরে এখানে গবেষণা করেন রোগের কারণ খুঁজে বের করতে। প্রতি বছর মে মাসের মধ্যদিকে ভারতে তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি থাকে। এ সময় শিশুদেরকে নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বাবা-মা দের। মাত্র একদিনে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে যাওয়া শিশুদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় তাদের। প্রতিটি অসুস্থ শিশুই সকালবেলা প্রচণ্ড কান্না করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। পরে তারা হৃদরোগে আক্রান্ত হয় এবং কোমায় চলে যায়। আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ শতাংশই মারা যায়। যখন বর্ষাকাল চলে আসে তখন এই রোগের প্রাদুর্ভাব হঠাৎ করে কমে যায়।
১৯৯৫ এর শুরুর দিকে ধারণা করা হত এই রোগের মূল কারণ হতে পারে হিট স্ট্রোক বা ইঁদুরবাহিত কোনও রোগ বা বাদুর বা মশাবাহিত রোগ বা লিচুবাগানে ব্যবহৃত কীটনাশক। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন না ঠিক কোনো কারণে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছিল। কখনো কখনো বিচ্ছিন্নভাবে এ রোগ না ছড়িয়ে সাধারণত কোনো গ্রামের একটি শিশু আক্রান্ত হতো। এমনকি একই পরিবারের মধ্যেও এ রোগ ছড়াতো না। ভারতের ন্যাশনাল সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এবং আটলান্টায় অবস্থিত ভারতীয় অফিস সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এবং প্রিভেনশনের যৌথ অনুসন্ধান করে মঙ্গলবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। যেখানে বলা হয় গ্রীস্মকালীন ফল লিচু এ অসুখের জন্য দায়ী। অপুষ্টিতে ভোগা কোনো শিশু খালি পেটে লিচু সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
২০১৫ সালে অন্য এক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যসেবা কর্মকর্তারা শিশুর বাবা-মা কে পরামর্শ দেন তারা যেন লিচু কম খাওয়ায়। ফলে পরের দুই ঋতুতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ১০০ থেকে ৫০ এ নেমে আসে।
ড. যাদব বলেন, ঘটনাটি খুব তীব্র হয়ে উঠছিল কারণ আমরা চোখের সামনে প্রতিদিন শিশুদের মৃত্যু দেখতাম। খুবই ভীতিকর অবস্থা ছিল বাবা-মাদের জন্য। তাদের শিশুরা অজানা কারণে মারা যাচ্ছিল কিন্তু আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না কেন এমন হচ্ছে। চার সূত্রের সাহায্যে তারা কারণ খুঁজে বের করেন। প্রথমত, ইনফেকশনের কোনো প্রমাণ ছিল না। ভুক্তভোগীর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কম ছিল। তৃতীয়ত, এ রোগের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে মৌসুমি ফলের একটা যোগ আছে। চতুর্থত, আক্রান্ত শিশুরা মেটাবলিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিল। গবেষণায় দেখা যায় হাইপোগ্লাইসিন সমৃদ্ধ ফল খেলে শরীরের গ্লুকোজ তৈরি হতে সমস্যা হয়। ফলে শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা যায়। লিচুতে প্রচুর পরিমাণের হাইপোগ্লাইসিন থাকে। যা শিশুদের শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি তৈরি করে।
গবেষকরা আক্রান্ত ৩০০ শিশুর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখতে পান। খালি পেটে প্রচুর পরিমাণে লিচু শিশুরা খায় এবং রাতের খাবার তারা খায় না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা যায়। শিশুরা দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা তাই পরামর্শ দিয়েছেন শিশুদেরকে অবশ্যই রাতের খাবার ঠিকমত খেতে হবে এবং লিচু থাওয়ার পরিমাণ কমাতে হবে। এ বিষয়ে বাবা-মা দেরকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।