কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আরও দু’শ বছর গবেষণা হবে বলে জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা আমাকে একবার বলেছিলেন তাঁর বাড়িতে আলাপকালে। তাই যদি হয় তাহলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে বাঙালি মাত্রই ভাববেন হাজারও বছর। তেমনি জাপানে এখনো প্রবীণদের মনে বেঁচে আছেন নেতাজি। যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁর বিচক্ষণ, উদার মানসিকতার পরিচয় পেয়েছেন তাঁরা বীরশ্রেষ্ট হিসেবে তাঁকে আজও শ্রদ্ধা করেন। তাই বলে প্রবীণ শুধু নয়, নতুন যারা আজকে জাপান-ভারত সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করছেন, শিক্ষালাভ করছেন তারাও নেতাজির সাহস ও দেশপ্রেমে একাধারে আর্দ্র ও উদীপ্ত হয়ে ওঠেন। আমরা বাঙালি বা ভারতীয়রা এতদিন বিশ্বাস করে এসেছি নেতাজির অন্তর্ধানে। কিন্তু আজ আর তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বিরতির পরক্ষণেই নেতাজি রহস্যময়ভাবে অন্তর্ধান হন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪৯। আজ ২০১৮ সালে তাঁর বয়স ১২২ বছর! এখনো কি আমাদের মনে করা উচিত তিনি বেঁচে আছেন কোথাও? এটা হবে একেবারেই অবাস্তব।
নেতাজিভক্ত জাপানিরা বিশ্বাস করেন সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট সোভিয়েত রাশিয়া যাওয়ার পথে তাইওয়ানের মাৎসুয়ামা বিমানবন্দরে এক বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। যে সকল জাপানি ও ভারতীয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁরা এবং দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ঘটনার কথা লিখে রেখে গেছেন। তাঁদের মধ্যে দু/একজন জাপানি ভক্ত বা সহযোগী বোধ হয় এখনো বেঁচে আছেন। সম্প্রতি প্রয়াত হায়াশিদা তাৎসুও লিখিত ‘হিগেকি নো এইয়ুউ চন্দ্রা.বোউস নো শৌগাই’=‘বিয়োগান্ত বীর চন্দ্র বসুর জীবন’ গ্রন্থের সারমর্ম নিম্নরূপ:
যুদ্ধের পরপরই ভারতের বৃটিশ সরকার নেতাজিকে গ্রেপ্তারকল্পে তাঁর অবস্থান অনুসন্ধানের জন্য তথ্যদপ্তরের দুজন বৃটিশ কর্মকর্তাকে দলপ্রধান করে দুটি দলকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করে। একটি দলের মধ্যে এইচ.কে.রয় এবং পি.কে.দে নাম্নী দুজন ভারতীয় গোয়েন্দা ছিলেন। তাঁরা খুঁজে খুঁজে বের করেন তাইওয়ানস্থ জাপানি সেনা অফিসার, হাসপাতালের ডাক্তার, অনুবাদক প্রমুখ নেতাজির দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদেরকে। তাঁদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন ঘটনার কথা এবং সরকারকে অভিহিত করেন। এই সংবাদের উপর ভিত্তি করে বৃটিশ সরকার নেতাজিকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থেকে মুক্তি দেন। কিন্তু এই সংবাদ সরকার প্রচার না করে অপ্রকাশিত বা গোপন রাখে। তবে এর মধ্যে নেতাজির মৃত্যুবরণের গুজব ছড়িয়ে পড়ে যদিও সেটা কেউ বিশ্বাস করেনি। এই ঘটনার এক মাস পরে ১৯৪৫ সালের ২২ শে সেপ্টেম্বর জাপান সরকার নেতাজির দুর্ঘটনার সংবাদ ভারতকে জানায়। তাও মানুষ কানে তোলেনি। অর্থাৎ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো শক্তিশালী, বিচক্ষণ বীরপুরুষ হঠাৎ করে দুর্ঘটনায় মারা যাবেন এটা ভারতীয়দের পক্ষে বিশ্বাস করা কষ্টকরই বটে তা নেতাজির বিপুল ভাবমূর্তির কারণেই।
তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেই এর সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুর পর নেতাজিকে তাইওয়ানেই তাঁর সহযোগীদের সামনে শবদেহ দাহ করা হয়। তাঁর দেহভস্মের একাংশ নিয়ে টোকিও আসেন জাপানি সহযোগী, ভক্তরা। এঁরা হলেন দুজন সামরিক কর্মকর্তা সাকাই ও হায়াশিদা তাৎসুও (লেখক) এবং অনুবাদক নাকামুরা জুউইচি। তাঁরা তা এনে জমা দেন কেন্দ্রীয় সেনা দপ্তরে। সেখান থেকে চিতাভস্ম গ্রহণ করেন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের টোকিও শাখা প্রধান রামমূর্তি এবং আয়ার। তাঁদের অনুরোধে টোকিওস্থ সুগিনামি-ওয়ার্ডে অবস্থিত রেনকোজি বৌদ্ধ মন্দিরে নেতাজি চিতাভস্ম সংরক্ষণ করা হয়।
অবশ্য একই রকম বর্ণনা পাওয়া যায় নেতাজির আরেকজন ভক্ত সম্প্রতি প্রয়াত জাপানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা কর্মসচিব হায়াশি মাসাওর বক্তব্যেও। তবে প্রকৃত ঘটনা দেশী-বিদেশী কারো লেখাতেই উঠে আসেনি আজ পর্যন্ত। সবই অনুমাননির্ভর তথ্য প্রামাণ্য নয়। কাজেই নেতাজির এই দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু মনে হয় এক স্থায়ী রহস্যময় ব্যাপার হয়ে যেতে বসেছে।
এই পর্যন্ত নেতাজির মৃত্যু বা অন্তর্ধান সম্পর্কে সরকারিভাবে তিনবার অনুসন্ধান করা হয়েছে। ১৯৫৬ সালে নেতাজিরই সহযোগী এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল শাহ্নাওয়াজ খান এবং ১৯৭০ সালে পাঞ্জাব হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জি.ডি.খোশলাকে প্রধান করে দুটি কমিশন জাপানসহ বিভিন্ন দেশে পাঠায় ভারত সরকার। তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সরকারকে জানান যে, নেতাজি তাইহোকু তথা তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন এবং রেনকোজি মন্দিরে সংরক্ষিত চিতাভস্ম তাঁরই যা জাপানিরা চাইছেন ভারতে নিয়ে গিয়ে সমাহিত করে একটি স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ১৯৫৭ সালে প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহরু জাপান সফরে এলে রেনকোজি মন্দিরে পা রেখেছিলেন এবং প্রতীজ্ঞা করেছিলেন চিতাভস্ম ভারতে নেবার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তিনি সেটা জীবদ্দশায় করেননি রহস্যময় কারণে। রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ জাপানে এসেছিলেন তিনিও কথা দিয়েছিলেন কিন্তু কিছুই করেননি।
১৯৫৮ সালে হায়াশি মাসাওসহ বেশ কিছু সংখ্যক নেতাজির সহযোগী ও ভক্ত ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৫ সালে যখন নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র অমিয়নাথ বসু জাপানে আসেন তখন কলকাতার মতো একটি নেতাজি স্মৃতিশালা গড়ে তোলার আবেদন জানান হায়াশিকে। ১৯৫৮ সালে সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও ২০০৬ সালে হায়াশিসহ অনেকেই মৃত্যুবরণ করার কারণে একাডেমী এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তবে রেনকোজি মন্দিরে প্রতিবছর ১৮ই আগস্ট নেতাজির মৃত্যু দিবস উপলক্ষে স্মরণ সভা নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, আয়োজন করছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। ভারতীয় দূতাবাস থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ অন্যান্য প্রবাসী ভারতীয় নাগরিক ও জাপানিরা উপস্থিত হন। এই লেখকেরও একাধিকবার উপস্থিত থাকার স্মৃতি রয়েছে।
এপর্যন্ত অনেক ভারতীয় এবং কতিপয় বাংলাদেশী নেতাজিকে শ্রদ্ধা জানাতে রেনকোজি মন্দিরে পদার্পণ করেছেন। নেতাজির আরেক ভাতুষ্পুত্র শিশির বসু এসেছেন, কবি ও লেখিকা কৃষ্ণা বসু এসেছেন। কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করেন নেতাজি মরেননি। এখনও করছেন কিনা কে জানে! তবে নেতাজির একমাত্র মেয়ে অনিতা এসেছিলেন তিনি নেতাজির মৃত্যুতে বিশ্বাস করেন। হায়াশি মাসাও জীবিতকালে লাগাতার নেতাজির চিন্তাভস্ম ফিরিয়ে নেবার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ, আবেদন করেছেন। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
১৯৯৯ সালে তৃতীয়বার অনুসন্ধান দল আসে, এবার কমিশনের নেতৃত্ব দেন প্রাক্তন বিচারপতি মনোজকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি জাপান ছাড়াও তাইওয়ান, রাশিয়া পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে প্রমাণাদি খুঁজে বেড়িয়েছেন। প্রতিবেদনে বলেছেন নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। রেনকোজিতে যে চিতাভস্ম আছে সেটার ডিএনএ পরীক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মন্দির কর্তৃপক্ষ নেতাজির চিতাভস্মের হাড় ভারতে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষার ব্যাপারে সহযোগিতা করছে না বলে আপাতত পরবর্তী কর্ম সম্পাদন হচ্ছে না বলে মত প্রকাশ করেছেন।
তথাপি যদি কখনো রেনকোজি থেকে নেতাজির চিতাভস্ম ভারতে নিয়ে যাওয়াও হয়, তারপরও জাপানের সঙ্গে তাঁর নিয়তির বন্ধন অত তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে যাবে না। যদিও খুবই অল্প সময়ের মধ্যে জাপানে এবং জাপানিদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন নেতাজি। ১৯৪৩ সালে জাপানে আসার আগেই তাঁর সম্পর্কে মানুষের ঔৎসুক্য ক্রমে ক্রমে বেড়ে উঠছিল। তৎকালীন তেইকোকু হোটেল বর্তমানে ইম্পেরিয়াল হোটেলে প্রায় এক মাস অবস্থান করার পর প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ লাভ করেছিলেন। এই বিলম্বের কারণ ফিল্ডমার্শাল অ্যাডমিরাল ইয়ামামোতো ইসোরোকু নিউগিনিয়ার বাউগেনভিল্ (Baugainville)
দ্বীপে মৃত্যুবরণ করেন মার্কিনী সেনার আক্রমণে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে। তাঁকে উদ্ধার করতে গিয়ে আরও কয়েকজন বিশিষ্ট সেনা গুরুতর আহত হন। এই অভাবনীয় সংকট সামলাতে তোজো অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন। তাছাড়া, ভারতকে সহযোগিতা করার ব্যাপারেও সেনাবাহিনী দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল বলে জানা যায়।
এই ঐতিহাসিক প্রথম সাক্ষাৎ ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। তাতেই সুভাষ বসুর সঙ্গে আলাপ করে তোজো তাঁর দেশাত্ববোধ, জাতিকে উদ্ধারের জন্য প্রতিশ্র“তিশীল মনোভাবের পরিচয় পেয়ে অভিভূত হন। খুব শীঘ্র আবার সাক্ষাতের প্রতিশ্র“তি দেন। এরপর দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারের সময় তোজোকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন নেতাজি, জাপান কীভাবে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করতে পারে? সেই সাহায্য ও সহযোগিতা অবশ্যই শর্তহীন হতে হবে মহাএশিয়াবাদের স্বার্থে। প্রাচ্যের স্বাধীন সত্তাকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখার আদর্শে জাপান-ভারতের ঐতিহাসিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের পরিপ্রেক্ষিতে এই বন্ধুত্ব আরও সুদৃঢ় করার প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বিশেষ কোনো ভূমিকা না রেখেই বলেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতা ভারতবাসীর জন্য হতে হবে, জাপানের জন্য নয়।
প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকি এই কথায় কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলেও প্রস্তাবে রাজি হন। নেতাজি আরও বলেছিলেন, ভারত অভিমুখী সমরযুদ্ধে ভারতীয় সেনা বাহিনীকে (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি [আইএনএ]) কে জাপানি সেনাবাহিনীর আগে আগে থেকে লড়াই করতে দিতে হবে। আমি চাই নির্ভীক ভারতীয় সেনা বাহিনী ভারতকে যুদ্ধ করে মুক্ত করুক। আরেকটি প্রস্তাব তিনি রেখেছিলেন পরে যে, সকল এশিয়ার দেশকে স্বাধীনতা দিতে হবে। তোজো হিদেকি নেতাজির ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনচেতা নেতৃত্ববোধ দেখে অত্যন্ত প্রীত হন এবং সকল প্রস্তাবে রাজি হন। এই নিঃশর্ত সহযোগিতা প্রদানের কারণে অনেক সহযোগী উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা মনোক্ষুণœ হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, তোজো হিদেকির মতো অত্যন্ত সূক্ষ¥ অনুভূতিসম্পন্ন এবং কঠোর নীতিবাগীস ব্যক্তিত্বকে নেতাজি যেভাবে বাগে আনতে সম্ভব হয়েছিলেন এমনটি আর কেউ পারতেন বলে মনে হয় না। সেজন্য নেতাজিকে ঝানু কূটনীতিকের ভূমিকা নিতে হয়েছিল।
এই এক মাসে নেতাজি জাপানের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, নৌঘাঁটি, হাসপাতাল ইত্যাদি পরিদর্শন করেন। রেডিওতে একাধিকবার ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলা ভাষায় দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তৃতা এবং ভারত শাসক বৃটিশের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেন।
জাপান শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্য ও স্বার্থবাদকে প্রত্যক্ষ করে ‘নেশন অব লীগ’ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। গঠন করেছিল অনুরূপ জাপান অধিকৃত পূর্ব এশিয়াভুক্ত দেশগুলো নিয়ে Greater East Asia Co-Prosperity Sphere ঝঢ়যবৎব (বৃহত্তর পূর্বএশিয়া যৌথ উন্নয়ন বলয়)। ১৯৪৩ সালে টোকিওতে একটি মহাসম্মেলনের আয়োজন করা হয় তাতে অংশগ্রহণ করেন বার মো (Bar Mo) ঝাং জিং হুই (Zhang Jing Hui), ওয়াং জিংওয়েই (Wang Jingwei),
হিদেকি তোজো (Hideki Tojo), ওয়াংওয়াই তাইয়াকঙ (Wanwai Tayakon), জোসে লওরেল (Jose Laurel)| । আর দেশগুলো ছিল বার্মা, মাঞ্চওকুও বা মাঞ্চুরিয়া, চীন, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম এবং লাওস। এই সম্মেলনে স্বাধীন ভারত সরকার তথা Free India Govt. এর প্রধান হিসেবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনে নেতাজি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে জাপানিদের কাছে বীরের সম্মান লাভ করতে সক্ষম হন।
নেতাজির সঙ্গে প্রতিশ্র“তি অনুয়ায়ী মনিপুর রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল অভিযানের পরিকল্পনা করে জাপান সরকার ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষদিকে। এই দিনের প্রতীক্ষায় ছিলেন এতটা বছর জাপান প্রবাসী মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু, অন্যান্য বিপ্লবী যেমন হেরেম্বলাল গুপ্ত, আনন্দমোহন সাহাই, এ.এম.নায়ার, দেশপাণ্ডে, রামমূর্তি প্রমুখ। এবং অবশ্যই আইএনএ-এর প্রধান সেনাপতি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। জাপানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে নেতাজির নেতৃত্বে হাজার হাজার আজাদ হিন্দ ফৌজ ছয় মাস প্রচণ্ড ঝড়জল ভেঙ্গে, বনজঙ্গলপাহাড় পেরিয়ে, অসুখে-বিসুখে ভোগে, হাজার হাজার সহযোগীর মৃতদেহ ডিঙ্গিয়ে নারকীয় যুদ্ধের ভিতর দিয়ে কোহিমা পর্যন্ত যখন পৌঁছালো তখন ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসা জাপান হঠাৎ করে আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা দিয়ে মিত্রশক্তি আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণ করে। সারা দেশ তখন বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। রাজধানী টোকিও চিরুনী বোমার আঘাতে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে একেবারে শ্মশান। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসের ১০ তারিখে চিরুনী বোমার আঘাতে নিমিষে ১০০,০০০ মানুষ মারা যায়। হিরোশিমা, নাগাসাকি আণবিক বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে। নেতাজি বাধাগ্রস্ত হলেন ঠিকই হতাশ হলেন না, বরং এই পর্যন্ত যে জাপান সহযোগিতা করেছে তার জন্য ধন্যবাদ জানালেন মনে মনে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন হিদেকি তোজোকে যদিও তিনি অবসর নিয়েছেন, নতুন প্রধান মন্ত্রী ও সেনাপতি হয়েছেন জেনারেল কোইসো কুনিআকি।
এই ঘটনায় আইএনএ তথা আজাদ হিন্দ ফৌজকে বিলুপ্ত করে দিলেন নেতাজি। তাঁর সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী তথা সহযোগীদের নিয়ে রাশিয়ার সাহায্য প্রার্থনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। জাপানি ফিল্ডমার্শাল তেরাউচি হিসাইচিকে অনুরোধ করলেন বিমানের ব্যবস্থা করে দিতে। তখন যুদ্ধ শেষ হওয়াতে সমগ্র এশিয়া থেকে জাপানি সৈন্য ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ স্বদেশে ফেরার জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ বিমান বা জাহাজ নেই। তেরাউচি নেতাজির আবেদন টোকিওস্থ সেনা সদর দপ্তরে জানালেন কিন্তু অনুমোদন মিলল না। তবুও তেরাউচি নেতাজিকে বিমানযোগে রাশিয়া পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এইভাবে জাপানিদের উদার সাহায্য-সহযোগিতা নেতাজিসহ প্রবাসী বিপ্লবীরা যেভাবে পেয়েছেন তার ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য-পথ্য দিয়ে শুধু নয়, নেতাজি ইম্ফল অভিয়ান ব্যর্থ হওয়ার পরপরই জাপানে এসেছিলেন তখন প্রধান মন্ত্রী কোইসো কুনিআকির কাছ থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যয়নির্বাহের জন্য তৎকালীন ১০০ কোটি ইয়েন ঋণ চেয়েছিলেন বলে জানা যায়। তাঁকে ঋণ বরাদ্দের পাশাপাশি সর্বোচ্চ রাজকীয় সম্মান ‘উদিত সূর্য’ পদক প্রদানের পরিকল্পনা করেছিল সরকার কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। বিনীতভাবে বলেছিলেন, এখনো ভারত স্বাধীন হয়নি, যেদিন স্বাধীন হবে সেদিন অধীনস্থ সকলকে নিয়ে এই পদক গ্রহণ করবেন, আজ নয়। ধারকৃত টাকার মধ্য থেকে এক কোটি খরচ করেছিলেন বাকি টাকা ভারতীয় সেনা বাহিনীর প্রতি দলনেতাকে ভাগ করে দেবার জন্য সঙ্গের অনুবাদক নেগেশি তাদামোতোকে আদেশ করেছিলেন। আরও আদেশ দিয়েছিলেন রাণী ঝাঁসী বাহিনীতে দুজন থাইদেশীয় তরুণী ছিল তাঁদেরকেও যথাযথভাবে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। তারপরই তাইওয়ানে বিমান দুর্ঘটনা (জাপানিদের মতে) ঘটার মধ্য দিয়ে জীবিত নেতাজির সঙ্গে জাপানের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু মৃত্যুর পর আজও তাঁর প্রবীণ-নবীন ভক্তরা তাঁকে স্মরণ করছেন এটা কম কথা নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ নিয়ে গবেষণাধর্মী নতুন নতুন গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে সেখানে নেতাজিকে সসম্মানে স্থান দিচ্ছেন লেখকরা। অথচ এই সেদিনও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা নেতাজিকে ‘তোজোর কুকুর’ বলে গালাগাল দিতেন। আজ তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝতে পেরে নেতাজিকে মাথায় তুলে নিয়েছেন অর্থাৎ সত্যের জয় হয়েছে।
টোকিওর সুগিনামি-ওয়ার্ডের মেয়র রাজনীতিবিদ নেতাজিভক্ত ইয়ামাদা হিরোশি বছর কয়েক আগে কলকাতায় অবস্থিত নেতাজি গবেষণা কেন্দ্র পরিদর্শন করে এসেছেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন নেতাজির একটি সুবৃহৎ স্মারক ভাস্কর্য মন্দিরের পাশ্ববর্তী উদ্যানে স্থাপন করবেন। আজ হোক কাল হোক সেটা হবে বলে বিশ্বাস করি। জাপান-বাংলা সম্পর্কের প্রদীপকে নতুন করে তিনি উসকে দিয়েছেন বলে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। বর্তমানে অবশ্য রেনকোজি মন্দিরের প্রাঙ্গণে পাথরের তৈরি নেতাজির আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত আছে।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
আলোকচিত্র:
১৯৪৩ বা ১৯৪৪ সালে টোকিওতে সুভাষচন্দ্র বসু